মুক্তিযুদ্ধে চারঘাটঃ বিধবাদের গ্রাম থানাপাড়া; শহীদ শিবলী
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, আমাদের জাতীয় সম্পদ। আর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সারা দেশের ন্যায় চারঘাটের দামাল সন্তানেরাও নিজের জীবন বাজি রেখে দেশ মাতাকে বাঁচাতে উদ্ধত হয়। যুদ্ধের সময় চারঘাট ছিল ৭ নং সেক্টরের ৪ নম্বর উপ সেক্টরে। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সারদা পুলিশ একাডেমিতে পাকিস্তানি পতাকা উঠেনি। তখন সেখানকার প্রিন্সিপাল ছিলেন আব্দুল খালেক। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের দেশ প্রেমিক ক্যাডেটরা সেদিন পাকিস্তানি পতাকা উঠতে দেননি। মুক্তিযুদ্ধে চারঘাটের এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বেশ অবদান ছিল। সারদা পুলিশ একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল মিঃ বড়ুয়াকে সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমানকে সম্পাদক করে ‘মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। আর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পান মোঃ মজিবর রহমান। পরে কমান্ডার হন মেজর রশীদ। ২৩ মার্চ মুক্তি সংগ্রামের নেতারা স্থানীয়দের সাথে নিয়ে ক্যাডেট কলেজে যান। সেখানে নাম পরিবর্তন করে মুক্তারপুর ক্যাডেট কলেজ নাম করণ করেন আর বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ বাকিয়াতুল্লাহ, অ্যাডজুট্যান্ট আব্দুর রশিদ সহ বাঙালী ক্যাডেটরা স্থানীয়দের পক্ষ নেন। তাঁরা ৩০৩ মার্কা রাইফেল মুক্তি বাহিনীর হাতে তুলে দেন। এদিকে পুলিশ একাডেমি থেকে পাওয়া যায় ৬০০/৭০০ রাইফেল আর গোলা বারুদ। ২৭ মার্চ কলেজের বাঙালী অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশীদ অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের সাথে নিয়ে রাজশাহী জেলার দক্ষিণ অংশে মুক্তিসংগ্রামের দায়িত্ব নেন। তিনি প্রথমে কাজীপাড়া ক্যাম্পে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতেন। পরে তিনি চারঘাট রেঞ্জের কমান্ডার নিয়োজিত হন। ক্যাপ্টেন রশীদ পরে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। তাঁকে সহযোগিতা করেন, বাংলার শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিকী, মিলিটারী সাইন্সের শিক্ষক শামসুল আলম।, ওয়ার্কসপ ইনস্ট্রাক্টর মোয়াজ্জেম হোসেন, হাবিলদার ইউসুফ প্রমুখ। শামসুল আলম ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন। ক্যাডেট এস এ মমিন বগুড়ায় যুদ্ধে শহীদ হন। তিনিই মুক্তিসংগ্রামের প্রথম ক্যাডেট শহীদ।ক্যাডেট কলেজের মোট ১৮ জন ক্যাডেট আর স্টাফ যুদ্ধে শহীদ হন।যুদ্ধের সময় অনেক ক্যাডেট বাড়িতে গিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন আবার কেউবা চারঘাটে থেকেই যুদ্ধ করেছেন। আর পুলিশ একাডেমির শহীদ হন ১৪ জন পুলিশ সদস্য ও স্টাফ ।
১৩ এপ্রিল আড়ানী ব্রিজের কাছে মুক্ত সেনারা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁরা ব্রিজ বোমা মেরে গুড়িয়ে দেন। এতে রাজশাহীর সাথে ঢাকার ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অতর্কিত আক্রমণে পাক সেনারা পিছে হটতে থাকে। চারজন পাক সেনার লাশ মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করতে পারেন। ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি হায়েনাদের আসার খবর পেয়ে বিড়ালদহে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্ত বাহিনীর দল। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয় আর পাক সেনারা সামনে আসার সুযোগ পায়। পরে বানেশ্বরে আরেক দফা প্রতিরোধের মুখে পরে পাক সেনারা। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন মুক্তি বাহিনীর দল। নাদের চেয়ারম্যান সহ অনেকেই সেদিন শহীদ হন। বানেশ্বর পতনের পর পাক হায়েনারা সারদার দিকে আগাতে থাকে। সারদা বাজারে আগে থেকেই ফাঁদ পেতে রেখেছিল মুক্তি বাহিনীর দল। কিন্তু তাদের আধুনিক অস্ত্রের মুখে পতন হয় সারদার। অনেকেই সেদিন শহীদ হন। এখানে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী মান্নাফ তাঁর ভাই সহ পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। সারদা পুলিশ একাডেমির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। দিশেহারা হয়ে প্রায় দুই-তিন হাজার আশ্রয় নেয় পদ্মার পাড়ে। সেখানে সেদিন প্রায় দেড় হাজার লোক প্রাণ হারান। এরপর পাক সেনারা চারঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। চারঘাট বাজারে আরেক দফা প্রতিরোধের মুখে পরে পাক সেনারা। সেখানে সম্মুখ সমরে শহীদ হন আবু বক্কর সিদ্দিকী বীর বীক্রম। সারদা পুলিশ একাডেমি, সরদহ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও ক্যাডেট কলেজ পরিণত হয় টর্চার সেলে। এসব স্থানে মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও নিরীহ লোকদের এনে নির্যাতন চালাত পাক সেনারা। যুদ্ধের সময় অনেকেই পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। অনেকেই যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেন। কথিত আছে ১৯৭১ সালে অনেক বৃষ্টি/বন্যা হয়েছিল। উত্তাল পদ্মা আর বড়াল নদী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধে অনেক সহযোগিতা করেছিল। কাকড়াঁমারী এলাকায় পদ্মার শাখা ‘চন্দনা’ নদীর মৃত খাত দেখিয়ে এক বৃদ্ধ বলেন, ১৯৭১ সালে এখানে দিয়ে হরদম নৌকা চলেছে। নৌকাতে করে বাঙালীরা চারঘাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নিত। আর মুক্তিযোদ্ধারা এই চন্দনা নদীর এই নৌ পথ দিয়ে ভোরে আর সন্ধ্যার পরে সুবিধা জনক স্থানে অবতরণ করে পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাত। পাক সেনারা এ দেশের রাস্তা-ঘাট কিছু চিনত না তবে তাদের দোসররা তাদের রাস্তা চিনতে সাহায্য করত। এটার সুযোগ নিয়েছিল গেরিলা যোদ্ধারা।
এপ্রিল মাসেই সারা দেশে প্রতিরোধের মুখে পাবনা থেকে রাজশাহীতে পালিয়ে যাওয়ার সময় নন্দনগাছীতে ২৪ জন পাকিস্থানি সেনাকে হত্যা করে স্থানীয় জনতা। দা, কুড়াল, খুন্তে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্থানীয় জনতা।
চারঘাটে দুইটি গণ কবর আর একটি বদ্ধভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। রায় সাহেবের ইট ভাটা আর লাদাড়া (নাওদাড়া) গ্রামের উত্তর-পশ্চিম দিকে দুইটি গণ কবর পাওয়া গেছে। পুলিশ একাডেমির পেছনে, থানাপাড়া নামক স্থানে চারঘাটের একমাত্র বদ্ধভূমির অবস্থান। চারঘাট উপজেলায় মোট মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২০৭ জন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চারঘাট শাখার কমান্ডার জনাব মোঃ আলমাস আর ডেপুটি কমান্ডার জনাব মো: ইমরান আলী। পাক হায়েনাদের আক্রমণে অনেক নারী তাদের সম্ভ্রম হারান। চারঘাটে এমন অনেক বীরাঙ্গনা থাকলেও লোক-লজ্জার ভয়ে তাঁরা সমাজের অন্তরালেই থাকতে পছন্দ করেন। চারঘাটে মোট ৭ জন আত্নস্বীকৃত বীরাঙ্গনা আছে। আর তাদের মধ্যে মাত্র একজন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত প্রাপ্ত। বাকিরা এখনো স্বীকুতির অপেক্ষায় আছেন। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করে এমন একটা এনজিওর মতে এর সংখ্যা আরো অনেক।
১৩ এপ্রিলের শহীদদের জন্য ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) এ বি এম তাজুল ইসলাম নির্মিতব্য স্মৃতি ফলকের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। পরের বছর ১৩ এপ্রিল স্থানীয় সাংসদ (বর্তমানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) জনাব মোঃ শাহরিয়ার আলম এটি উদ্বোধন করেন। সেখানে ১৭৪ জন শহীদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এখনো নাম না জানা আরো অনেক শহীদের খবর সবার অলক্ষ্যেই থেকে গেছে।
বিধবাদের গ্রাম থানাপাড়াঃ
১৯৭১ সালে পাক বাহিনী ও তোদের দোসর রাজাকার , আলবদর, আল-শামস মিলে সারা দেশে হত্যালীলা চালায়।
চারঘাটও এর ব্যতিক্রম না। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী থানাপাড়া নামক গ্রামে এক নৃশংস হত্যালীলা চালিয়েছিল। সেদিন পাক সেনারা সারদা বাজার ক্রস করার সময় ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তবে তাদের ভারী অস্ত্রের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয় । পাক সেনারা পুলিশ একাডেমি দখলে নেয়। খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পরলে থানাপাড়া সহ আশেপাশের গ্রাম থেকে লোক একত্রিত হয় পদ্মার চরে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পদ্মা পাড় হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া। সঠিক সংখ্যা পাওয়া না গেলেও সেদিন প্রায় দুই হাজারের বেশি লোক চরে জমা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই খবর পাক হায়েনার দলের কাছে গেরে তারা থানাপাড়ার চরের দিকে অগ্রসর হয়। চরে সেদিন বেশি নৌকা ছিল না। যা ছির সেটা দিয়ে সবার পারাপারের কোন উপায় ছিল না। অবশ্য কিছু মানুষ আগেই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। সামনে নদী আর পেছনে পাক সেনা। অবশেষে হায়েনার দল থানাপাড়া-কুঠিপাড়ার লোকদের পাকড়াও করে ফেলে। তারা সবাইকে সারি সারি করে দাড় করায়। প্রথমে এরা গুলি চালায় না। গভর্নর টিক্কা খানের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর নেয়। জালেম টিক্কা খান তার অনুগত পশুদের বলে-“ বাচ্চা-বুড্ডো বাদ সাব খাতাম কার দো।” পশুগুলির মধ্যে মনুষত্বের লেশ মাত্র থাকলে তারা এসব ঘৃণ্য কাজ করতে পারত না। মহিলা আর বাচ্চাদের আলাদা রাখা হয়। পুরুষদের একে একে হত্যা করা হয়। যুবক বৃদ্ধ কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একজন বৃদ্ধ স্বেচ্ছায় শহীদ হন। তিনি বলেন-“ তুমরা সব মরি গেলে আমরা ব্যাঁচি থ্যাকপ কিসের ল্যাগি?” বৃদ্ধের নাম ছিল আব্দুর রহিম খলিফা। একে একে হত্যা করে তাদের লাশ স্তুপাকারে জমা করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অযত্নে অবহেলায় অনেক লাশ পড়ে থাকে সেখানে। জীবিত লোকেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফিরে আসে তিন দিন পর। ততদিনে লাশ সনাক্ত করা অসম্ভব ছিল। লাশের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়িয়েছে প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে। অনেক লাশের বিক্ষীপ্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। চিল-শকুন কুড়ে কুড়ে খেয়েছে এসব লাশের অঙ্গ-প্রতঙ্গ। সেদিনের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী আজও বেঁচে আছেন। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আজও তাদের গাযে কাঁটা দেয়। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডীন ড. মোঃ জিন্নাতুল আলম। তিনি জানান, সেদিন সবার সাথে তাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে লােইনে দাড় করানো হয়। তাঁকে দেখে শিক্ষিত মনে হলে পাক সেনারা তাঁকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করে। তিনি নিজেকে বিশ্ববিদ্যারয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন। তাঁর নাম জিন্নাহ শুনে থমকে যায় পাক সেনারা। পাকিস্তানের জাতির জনকের সাথে তাঁর নামের মিল থাকায় পাক সেনাদের মনে দয়া জাগে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন-“ দেখিয়ে, মুজকো মারিয়ে কোই আফসোস নেহি; লেকিন মেরে মাকো কন দেখেগা?” তারা তাকে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ছেড়ে দেয়। সেদিন দলের সাথে থাকা মাহমুদা বেগম গিনি, যিনি এখন থানাপাড়া সোয়ালোজের সহকারী নির্বাহী প্রধান বলেন, বেলুচ সেনারা তুলনা মূলকভাবে ভাল ছিল। সেদিনের ঘটনা অনেক মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়। অনেক মহিলা এমনকি নব বধুকে বিধবা হতে হয়। অনেকেই গুলির চিহ্ন নিয়ে বেঁচে ছিল/আছে এখনো। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর সবাই এই গ্রামকে “বিধবাদের গ্রাম” বলতে থাকে। এক সাথে এত বিধবা এই অঞ্চলে আর কোথাও দেখা যায়নি। উল্লেখ্য, পাক হায়েনাদের আক্রমণে সারা দেশে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। তবে এক সাথে, একি সময়ে এত গুলি লোক আর কোথাও শহীদ হয়নি। সেদিক থেকে থানাপড়ার গণহত্যার বিষয়টি আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যয়ে মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। এই ঘটনার পর ১৯৭২ সালে অসহায় ও বিধবাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলোপমেন্ট সোসাইটি’- নামের একটি এনজিও গঠিত হয়।
শহীদ শিবলীঃ দেশমাতাকে শত্রু মুক্ত করতে প্রাণ দেন প্রায় ৩০ লক্ষ বাংলা মাতার সন্তান। এমনই একজন “শহীদ শিবলী”, যিনি বীরের মত দেশের জন্য লড়াই করে শহীদ হয়েছেন। শহীদ শিবলী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাড়ি থানাপাড়া গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়। যুদ্ধের সময় থানাপাড়ায় এসে তিনি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর আসল নাম খোরশেদ আলম।তাঁর পিতার নাম অ্যাডভোকেট আজিজুল আলম আর মাতার নাম জাহেরা বেগম। খাঁটো গড়নের শিবলী যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনি ছিল তাঁর রণ কৌশল। প্রতিদিন রাতে তিনি বাড়ি ফিরতেন। মায়ের হাতে খাবার খেয়ে ভোড় থাকতেই আবার চলে
যেতেন। একদিন এর ব্যতিক্রম হল। সকাল হয়ে এলেও তিনি বাড়ি ত্যাগ করতে পারেননি। অবশেষে বাড়ি ত্যাগ করে যাবার পথে দেখা হয় এলাকার এক জামাইয়ের সাথে। সেই মীরজাফর রাজাকার থানাপাড়াতেই থাকত। সে তাঁকে তার বাড়িতে আশ্রয় নিতে বলে। পথে পাক সেনারা দেখলে সমস্যা হবে ভেবে তাকে বিশ্বাস করে শহীদ শিবলী তার বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরে সেই রাজাকার পুলিশ একাডেমিতে গিয়ে পাক সেনাদের খবর দিয়ে আসে। এভাবেই পাক সেনাদের হাতে তিনি ধরা পড়ে যান। তারা শহীদ শিবলীকে টানা দুই দিন পুলিশ একাডেমি আর পাইলট স্কুলে নির্যাতন করতে থাকে। বার বার তাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলার জন্য জোর করতে থাকে। মাথা নিচে, পা ওপরে রেখে তারা নির্যাতন চালাতে থাকে। তারপরেও তারা তাঁকে বশে আনতে না পেরে অথ্যাচারের মাত্রা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও তারা তাঁর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কোন তথ্য পায়নি।
শহীদ শিবলী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার |
তারা শহীদ শিবলীকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বললে তিনি তাদের মুখে থুঁতু ছিটিয়ে উত্তর দেন, “জয় বাংরা, জয় বঙ্গবন্ধু। আমার মত অনেক শিবলী ভারতে তৈরি হচ্ছে। তোরা কয়জনকে মারবি?” এরপর তারা জীবিত অবস্থায় তাঁর চোখ উপড়ে নেয়। চামড়া ছিলে লবণ ছিটিয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও তারা তাঁর মুখ থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ কিংবা কোন রকমের তথ্য পায়নি। ৯ জুন পাক হায়েনার দল তাকে বড়ালের ধারে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর সাথে দশম শ্রেণীর ছাত্র আফসার আর উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র রিয়াজও শহীদ হন। পরে লাশ বড়াল নদীতে ফেলে দেয়। পর দিন নদীতে লাশ ভেসে উঠে। শহীদ শিবলীর মা বড়ালের ধারে গিয়ের ছেলের লাশের সন্ধান পান। পরে তাঁকে দাফন করা হয় পারিবারিক করবস্থানে। শহীদ শিবলী মিশে আছেন আমাদের অন্তরে, আমাদের চেতনায়। শহীদ শিবলীর নামে চারঘাট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ( শহীদ শিবলী শহীদ মিনার) নাম করণ করা হয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাবঃ মোঃ শাহরিয়ার আলম তাঁর আগের মেয়াদে এটি উদ্বোধন করেন। চারঘাট পল্লী বিদ্যুৎ মোড় থেকে থানাপাড়া সোয়ালোজগামী সড়কটির নাম ‘শহীদ শিবলী’র নামে নাম করণ করা হয়। এছাড়াও চারঘাটে তাঁর স্মরণে গড়ে উঠেছে আরো অসেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। স্বাধীনতার ৪৬ বছরের মাথায় শুধু একটি প্রশ্ন বার বার উঁকি দেয় । শহীদ শিবলীকে কেন রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হল না?
আরো দেখুনঃ
সরদহ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়
সারদা পুলিশ একাডেমী
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ
চারঘাটের নারদ নদ
চারঘাটের মুসা খান নদ
প্রাচীন চারঘাটের নাম সমূহ
চারঘাটের বড়াল নদ
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
ঐতিহ্যের চারঘাটঃ ডা. মোঃ আব্দুল মালেক
মাহমুদা বেগম গিনি ; সহকারী নির্বাহী প্রধান, থানাপাড়া সোয়ালোজ ডেভেলোপমেন্ট সোসাইটি
মোস্তাফিজ; ক্যাডেট কলেজ ব্লগ
#নিরিবিলি
ব্লগ লিখেছেনঃ
মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি
অর্থনীতি বিভাগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তালিকা
উত্তরমুছুনচারঘাটের শহিদের তালিকা
উত্তরমুছুন