চারঘাটের নদ-নদী, ১ম পর্বঃ গঙ্গা/পদ্মা নদী (Ganges/Padma River)
ব্লগ লিখেছেনঃ মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি
#নিরিবিলি
পদ্মাঃ
উৎসঃ হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী উপত্যকা
মোহনাঃ বঙ্গোপসাগর
হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী উপত্যকা থেকে জন্ম নিয়ে গঙ্গা হরিদ্বারের নিকট এসে সমতল স্পর্স করেছে। আসলে গাঙ্গেত্রী উপত্যকা থেকে বয়ে আসা জলধারা/নদীটি ভাগীরথী নামে পরিচিত। এটিকে গঙ্গার উৎপত্তি স্থল বলা হলেও মূল গঙ্গার জন্ম মূলত ভাগীরথী আর আলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল থেকে। এখানে আলকান্দা ভাগীরথীর চেয়ে অনেক বড় নদী। অলকানন্দার উৎসস্থল নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট শৃঙ্গের বরফগলা জল। গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলি ছোট নদী। এর মধ্যে ছটি দীর্ঘতম ধারা এবং গঙ্গার সঙ্গে তাদের সঙ্গমস্থলগুলিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করে। এই ছটি ধারা হল অালকানন্দা, ধৌলীগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মান্দাকিনী ও ভাগীরথী। পঞ্চপ্রয়োগ নামে পরিচিত পাঁচটি সঙ্গমস্থলই অলকানন্দার উপর অবস্থিত।
ছবিতে আলকানন্দা আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থল দেখানো হয়েছে। ডান পাশের নদীটি আলকানন্দা আর বাম পাশের নদীটি ভাগীরথী। গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের কিছু পূর্বে তার প্রধান শাখা নদী ভাগীরথীর জন্ম দেয়। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকাসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন দিয়ে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়েে এসে নদীটি ইউসুফপুর ইউনিয়ন (শাহপুর) দিয়ে আমাদের চারঘাট উপজেলায় প্রবেশ করে। এটি বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম/দীর্ঘতম নদী; বাংলাদেশ অংশে দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিঃমিঃ। মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪০০ কিঃমিঃ। প্রায় ২২০০ কিঃমিঃ পথ পরিক্রমার পর পদ্মা গোয়ালন্দের নিকট ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সাথে মিলিত হয়েছে। এরপর মিলিত ধারা পদ্মা নাম নিয়ে চাঁদপুরের কাছে বঙ্গোপসাগরের খাড়ির কাছাকাছি এসে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে। অতপর মিলিত ধারা মেঘনা নাম শাহবাজপুর চ্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ‘গঙ্গার’ উল্লেখ্য উপনদী গুলি হল যমুনা, ঘর্ঘরা, গোমতী, শোন, গণ্ডক, কোশী ( কৌশিকী ),মহানন্দা ইত্যাদি। বাংলাদেশ অংশে পদ্মার উপনদীর মধ্যে মহানন্দা ও যমুনা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ অংশে গড়াই (মধুমতি) পদ্মার প্রধান শাখা নদী। এছাড়াও আড়িয়ার খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, বড়াল, চন্দনা, পাগলা, ভৈরব, নারদ ইত্যাদি পদ্মার প্রধান শাখা নদী। বড়াল পদ্মার বাম তীরের প্রধান শাখা নদী। গঙ্গা কেন কোথায় এবং কিভাবে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করেছে তা নিয়ে এখনো নদী বিজ্ঞানীগণ কোন সুরাহা করতে পারেনি। তবে চারঘাটের নিকট এসে গঙ্গা পদ্মা নাম ধারণ করেছে এটা নির্দিধায় বলতে পারি। কারণ ১৬৬০ সালের ম্যাপে আমরা দেখতে পায় যে চারঘাটের নিকটে এসে মহানন্দা গঙ্গার সাথে চূড়ান্তভাবে মিলিত হচ্ছে। এরপর একটি ধারা পূর্ব দিক বরারবর ‘গঙ্গা’ নাম নিয়ে চলন বিলের দিকে প্রবাহিত থাকে। আর আরেকটি ধারা ‘পদ্মা’ নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। চলন বিলের ধারাটি আসলে আজকের বড়াল নদী যা নাকি এক সময় গঙ্গা নামে প্রবাহিত হত। এই ধারাটি ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে ‘শীতলক্ষ্যা’ নদীকে ধারণ করে মেঘনা নদীর সাথে মিশে চট্রগ্রামের নিকট দিয়ে বঙ্গপসাগরে পতিত হত। ভৈরবের নিকট মেঘনার ঐ অংশ তখন প্রমত্তা ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণের ধারাটি নানা পথ ঘুরে ফরিদপুরের নিকট দিয়ে পদ্মাবতী নামে পতিত হত। মধ্যযুগের প্রথমে এই ‘পদ্মাবতী’র অস্তিত্ব বর্তমান ছিল বলে গবেষকরা একমত হয়েছেন। চারঘাট থেকে গঙ্গার সেই দক্ষিণমুখী ধারায় যে পদ্মবতী সেটা নিয়ে কারো বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। ধারণা করা হয় যে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ধারাটি ক্ষীণ ছিল। চর্যাপদে তাই ‘পদ্মা খাল’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আর প্রায় ৫০০ বছর আগেই এই ধারাটি গঙ্গার মূল ধারায় পরিণত হয়। পশ্চাদশ দশকের কবি কাশিরাম দাস তাঁর মহাভারতে তাই এই ধারাকে ‘বড় গঙ্গা’ বলেছেন। পুরো বিষয়টাকে এক কথায় বললে এটাই দাঁড়ায় যে চারঘাটের নিকট এসে গঙ্গা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ‘পদ্মা’ আর আরেকটি ধারা ‘গঙ্গা’ (বড়াল) নামে প্রবাহিত হত।
আরো দেখুন: চারঘাটের নারদ নদ
চারঘাটের মুসা খান নদ
আমাদের চারঘাটের পদ্মাঃ
পদ্মাকে যদি চারঘাটের হৃদপিণ্ড বলি তাহলে বিন্দু মাত্র ভুল হবে না। এটি চারঘাটের অর্থনীতির মূল বাহক। বর্তমানে পদ্মা তার জৌলুস হারিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মার এই দুরাবস্থা। এককালে পদ্মায় বড় বড় স্টীমার চলত। পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠেছিল স্টীামার ঘাট ও থানা ঘাট । নওয়াবী আমল থেকে পদ্মার পাড় ঘেষা চারঘাট বন্দর দিয়ে কলকাতা, ঢাকা, নাটোর ও রাজশাহীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা হত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক গবেষণা করে দেখেছেন যে, পদ্মার কারণেই চারঘাটের আমের অমৃত সম স্বাদ। পদ্মার প্রাচীন নাম ‘নলিনী’। মহাকবি কৃত্তিবাস পদ্মাকে বড় গঙ্গা বলে অবিহিত করেছেন। পদ্মা নামের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় বাংলার প্রথম সাহিত্যকর্ম ‘চর্যাপদে’। আর আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’তে প্রথম পদ্মা নদীর নামের উল্লেখ আছে। কোন এক সময় পদ্মা চলন বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত। পদ্মার সেই খাতটি বর্তমানে নারদ নামে পরিচিত। পদ্মা বার বার খাত পরিবর্তনের জন্য খ্যাত। পদ্মা পূর্বে আরো প্রায় ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণে ভগবানগালার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের নিকট বঙ্গোপসাগরে পতিত হত। ‘পাগলা, বড়াল, গড়াই, ভৈরব, কুমার, আড়িয়াল খাঁ’ পদ্মার প্রাচীন খাত সমূহ। বতৃমানে এগুলা পদ্মার শাখা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মায় আগে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ পাওয়া যেত। প্রায় দশ বছর পর গত বছর থেকে চারঘাটে সীমিত আকারে ইলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এসব ইলিশ স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হয়। পদ্মায় পানি কমে আসায় আগের মত আর ইলিশের দেখা পাওয়া যায় না। সম্প্রতি চারঘাটের বিভিন্ন স্থানে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মার নাব্যতা সঙ্কট এর অন্যতম কারণ। এক সময় পদ্মায় দেখা মিলত কুমি সদৃশ ঘরিযালের। খ্যাদের অভাব, ব্যাপক হারে শিকার, নাব্যতা কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ঘরিযালের সংখ্যা এখন অতি নগণ্য পর্যাযে পৌছেছে। স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যেই ঘরিয়াল রক্ষায় জনসচেতনতা সহ আরো বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। পদ্মার ঘরিয়াল সব স্থানে পাওয়া যায় না।
ঘরিয়ালের মত শুশুকও পদ্মার বুক থেকে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। শুশুক এক প্রকার ডলফিন।পদ্মার শুশুক পৃতিবীতে খুব বেশি পাওয়া যায় না। এটির নাম গাঙ্গেয় শুশুক। পৃথিবীর বিরলতম প্রাণী এটি। এখনো মাঝ পদ্মায় উঁকি দেয় স্তন্যপায়ী প্রাণীটি। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পানির ওপর আসতে হয় শুশুককে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এদের চলাচলের পথ কমে গেছে। আর তাই হ্রাস পেয়েছে এদের প্রজনন ক্ষমতা। খাবার সঙ্কট, নদীতে কারেন্ট জাল ব্যবহার ইত্যাদি কারণে শুশুকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও পদ্মায় এখন অনেকে অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য বাঁশের ফাঁদ পেতে রাখছে। আর এই ফাঁদের কারণে শুশুক আর আগের মত চলাচল করতে পারছে না। অনেক সময় মারাও পরছে প্রাণীটি। পদ্মার আরেকটি বিপন্ন প্রণী হর কাছিম। এক যুগ আগেও পদ্মার চরে, বিশেষ করে ইউসুপপুর, মুক্তারপুরের চরে কাছিমের ডিম পাওয়া যেত। কিন্তু এখন যায় না বললেই চলে। কাছিমের শিকারের কারণে দিন দিন নিঃশেষ হচ্ছে এই অঞ্চলের কচ্ছপ গুলি।
চারঘাটে পদ্মার পাড়ে বেশ কয়েকটি বালু মহাল আছে। বর্তমানে মুক্তারপুর ও থানাপাড়া মৌজাতে দু'টি বালু মহাল আছে। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়াও রাওথা ও থানাপাড়া গ্রামে আরো দু'টি বালু মহাল আছে। পদ্মা এভাবেই চারঘাটের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে।
শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে নৌকা নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে।
নিচের ছবিতে জানুয়ারী মাসে শান্ত পদ্মা
চারঘাটে পদ্মার বেশ কযেকটি চর জেগে উঠেছে। এগুলা স্থানীয়দের কাছে গঙ্গা চর নামে পরিচিত। ইউসুফপুর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে একটি বড় চর বড়ালের মুখ বরাবর চলে এসেছে। রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার চরে এখন নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাস। এখানে আশ্রয় নিয়েছে বিরল প্রজাতির অনেক পাখি। চরে নানা প্রজাতির গাছের সমারহ দেখা যায়। কয়েকটি চরে লোকালয় গড়ে উঠলেও বেশির ভাগ চর এখনো জনমানবহীন। এসব চরে রাখাল গরু, ছাগল ও মহিষের পাল নিয়ে নৌকাতে করে আসে। সবুজ ঘাসে তৃপ্ত হওয়ার পর রাখাল তার পোষ্য নিয়ে আবার আপন আলয়ে ফিরে যায়।
তবে পদ্মার চর রাজশাহী অঞ্চলে বেশ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা এখন খানিকটা পশ্চিম দিকে সরে গেছে। আর শহরের পাশে বড় বড় চর জেগে উঠেছে। ফলে রাজশাহীর পাশের প্রমত্তা নদী ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। এখন জেলেরা এই অংশে বেশি মাছ পাচ্ছে না। চর জাগায় নদীর মূল অংশ পশ্চিমে সরে গেছে। ফলে পদ্মা যৌথ নদীতে পরিণত হচ্ছে। বেশ কিছু চর ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে। সেসব অংশের পদ্মা এখন যৌথ নদী। বাংলাদেশের জেলেরা এখন আর ভারতের অংশে যেয়ে মাছ ধরতে পারছে না। আবার পদ্মা পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ায় রাজশাহীর আরো বেশ কিছু চর বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এসব চর বিলীন হলে পদ্মা যৌথ নদীতে পরিণত হবে আর ক্ষতিগ্রস্থ হবে রাজশাহী অঞ্চলের অগনিত মানুষ। পদ্মা গার্ডেনের কাছে পদ্মা একটি ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। পদ্মা গার্ডেনের কিছু দক্ষিণে আছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের এক নাম্বার ড্রেন সহ আরো বেশ কিছু ড্রেন। ড্রেনটি পূর্বে পদ্মার শাখা নদী বারাহী বলে পরিচিত ছিল। প্রতিনিয়ত সেসব ড্রেন থেকে পানি আসছে বলে সামান্য পানি আছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি নাই আবার বর্ষাকালে ফারাক্কার গেট খুললে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে পুরো জনপদ। চারঘাটে পদ্মা মেতেছে এক ভয়ংকর উম্মাদনায়। বিশাল চর পড়ায় পদ্মার বাম অংশ বইছে ক্ষীণধারায়। নলকূপে পানি উঠছে না, মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। চরের ওপাশে নদীর মূল ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। আবার বর্ষাকাল এলেই তীব্র গতিতে পদ্মা বিনাশ করছে লোকালয়। ইউসুফপুর, টাঙ্গনের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল পদ্মার গর্ভে বিলীন হচ্ছে। রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিছুই বাদ যাচ্ছে না। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন নিরিবিলি এলাকায় ব্লক ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। চরম হুমকির মুখে আছে পদ্মার বামতীর রক্ষা বাধঁ। তবে চারঘাটের নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে বড়াল। পদ্মাতে সারা বৎছর সামান্য পানি থাকলেও বড়ালে সেই পানি যাচ্ছে না। বছরে মাত্র চার মাস পদ্মা থেকে বড়ালে পানি আসে। বড়ালের উৎস মুখের কাছে চর পড়ায় এখন আর পদ্মার বিপুল জলরাশি বড়ালে প্রবেশ করছে না। রেনেলের ম্যাপে (১৭৬৫-১৭৭৬) গঙ্গা চর ছিল নারদ আর বড়ালের মধ্যবর্তী অংশে। এখন সেই চর আকারে অনেক গুন বেড়েছে। ফারাক্কা বাধঁ নির্মাণের পরেও, স্লইচ গেট নির্মাণের আগেও যেখানে বড়ালে প্রায় ২১০০০ কিউসেক পানি আসত এখন আসে মাত্র তিন হাজার। কিন্তু সেই পানিও আসে মাত্র বছরে মাত্র চার মাস। বড়ালের উৎস মুখের কাছে পদ্মার পানি কমে যাওয়ার কারণে এই সমস্যা। বড়ালে পানি বৃদ্ধির জন্য বড়ালের মুখ কয়েকবার খনন করা হয়েছে। অথচ পদ্মার নির্দিষ্ট অংশে ডেজিং করা না হলে বড়ালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
চারঘাটে পদ্মার বেশ কিছু শাখা নদী আর খাল আছে। বড়াল, নারোদ, চন্দনা, ইছামতি ইত্যাদি নদী চারঘাটের বক চিরে বয়ে যেত। চন্দনা আর ইছামতি চারঘাটের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। ইউসুফপুর থেকে পদ্মার বেশ কিছু খাল রাজশাহীর বুক চিরে বয়ে গেছে। বিখ্যাত মৈত্রেয় সাহেবের দাড়া তথা বাপ মারার খাল বেলপুকুরিয়ার পাশ দিয়ে পুঠিয়ার দিকে বয়ে গেছে। বিখ্যাত 'কাটা খাল' ইউসুফপুর দিয়ে কাঠাখালীর দিকে বয়ে গেছে। ইউসুফপুর ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি স্লুইচ গেট আছে। পদ্মার পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে এগুলা নির্মাণ করা হয়। তবে এসবের ফলে অনেক নদী ও খাল অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।
আরো দেখুন: চারঘাটের বড়াল নদ
চারঘাটের মহানন্দা নদ
ছবিতে পদ্মার বুকে সন্ধা নামছে।
পদ্মার গতিপথঃ
পদ্মার গতিপথ সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। টলেমি গঙ্গা নদীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় প্রাচীন গঙ্গা নদী প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান গোয়ালন্দ থেকে অনেক উত্তরে ঢাকা ভাওয়ালের পাশে ‘এ্যান্টিবোল’ হয়ে প্রবাহিত হতো। তখন ঐ অঞ্চলকে ‘এ্যান্টিবোল সাগর’ বলে পরিচিতি রয়েছে (জেমস টেলর)। প্রাচীন কালের শেষ দিকে ও মধ্য যুগের প্রথম দিকে পদ্মা ছোট নদীতে পরিণত হয়। তখন গঙ্গার মূল ধারা ভাগীরথী, গড়াই প্রভৃতি দিয়ে প্রবাহিত। মধ্যযুগের সূচনার পরে পদ্মাকে চট্ট্রগ্রামের নিকট ব্রহ্মপুত্রের সাথে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে দেখা গেছে। ফরিদপুরের ইদিলপুরে মধ্যযুগের নিদর্শনে পদ্মাবতীর নামের সন্ধান পাওয়া যায়। মূলতঃ ৩০০/৪০০ বৎসর পূর্বে পদ্মার ধারা বর্তমান ধারা থেকে আরো উত্তরে বোয়ালিয়া (রাজশাহী শহর) পাবনার চলনবিল, ইছামতি (মানিকগঞ্জ) ধলেশ্বরী একাকারে ঢাকার দক্ষিণ দিয়ে শ্রীপুরের কীর্তিনাশা হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হত। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্যকারী, ইতিহাসের খলনায়ক রাজা রায় বল্লভের প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরের মন্দির ও প্রাসাদ ধবংস করে পদ্মা কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে। এখন পদ্মা ভগবানগোলা থেকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ উত্তরে সরে এসে রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত।
পদ্মার গতিপথ নবীন না প্রাচীন?
পদ্মার গতিপথ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়ে আসছে। অনেকেই, বিশেষত ভারতের নদী গবেষকগণ মত দিয়ে থাকেন যে ভাগীরথী খাতটি পদ্মার চেয়ে প্রাচীন। পূর্বে গঙ্গার মূল ধারা ভাগীরথী দিয়ে প্রবাহিত হত। আর পদ্মার সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েকশত বছর পূর্বে। এর আগে গঙ্গার পানি পদ্মায় যেত না অথবা পদ্মা নামের কোন নদীই ছিল না। এবার কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
এক.
ইতিহাসগ্রন্থে ধরে নেয়া হয়েছে যে, পদ্মা নামের গঙ্গার শাখাটি নতুন। এর আদিশাখা ভাগীরথী। যেমন: ‘একসময়ে গঙ্গার জলস্রোত একমাত্র ভাগীরথী দিয়েই প্রবাহিত হত; পরে এই জলরাশি পদ্মা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভাগীরথী ক্ষুদ্রকায়া নদীতে পরিণত হল। … পবিত্র গঙ্গানদীর বেশীর ভাগ জল এখন পদ্মাগর্ভ বহন করছে; তাই পদ্মা এখন একটি মহানদী। তবু কিন্তু গঙ্গাজলের পবিত্রতা এই ভাগীরথী বা হুগলী নদীর জলে বর্তমান; পদ্মার জলে তা নেই। দূর দূর থেকে পুণ্যার্থীরা এই ক্ষুদ্র নদীগর্ভেই স্নান করতে আসে।’ (ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত)
দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁর পালপূর্ব যুগের বংশানুচরিত নামের গ্রন্থটিতে প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আলোচনায় সঙ্গত কারণেই পদ্মার প্রবাহ পরিবর্তনের উল্লেখ অনেকবার করতে বাধ্য হয়েছেন, আধুনিক কালের পদ্মার প্রবাহ বিষয়ে তার একটি উল্লেখ থেকে পাঠকেরা পদ্মার প্রাচীন ও হাল আমলের নড়াচড়া সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন: ‘ফরিদপুর জেলার ইদিলপুরে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীর চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের শাসনে পদ্মা (পদ্মাবতী?) নদীর সর্বপ্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন এ অঞ্চলে পদ্মানামের যে ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিতা ছিল, পরে গঙ্গার পূর্বশাখার জলস্রোত তার খাতে পড়ার ফলে সেটি ক্রমে সুবৃহৎ নদীতে পরিণত হয়ে পদ্মা নাম পায় বলে মনে হয়… বিগত কয়েক শতাব্দীতে পদ্মা নদীর বহু বিবর্তন ঘটেছে। পন্ডিতেরা মনে করেন পদ্মা এক সময় রামপুর বোয়ালিয়ার কাছ দিয়ে চলন বিলের পথে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার খাতে ঢাকা পেরিয়ে মেঘনার নিম্নভাগে পড়ত; কিন্তু অষ্টাদশ শতকে নদীটি ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে এসে দক্ষিণ শাহাবাজপুর দ্বীপের উপর দিকে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুরের প্রায় বিশ মাইল দক্ষিণে মেঘনার মোহনায় মিলিত হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবগণের সভাসদ রাজা রাজবল্লভের নির্মিত রাজনগর এক সময় পদ্মার বামতীরে অবস্থিত ছিল এবং নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদী পদ্মা ও মেঘনাকে সংয্ক্তু করত। রাজনগর প্রভৃতি বহুজনের কীর্তি পদ্মাগর্ভে বিলীন হওয়ায় এখানে নদীর নাম হয় কীর্তিনাশা।’
দীনেশচন্দ্র সরকার গঙ্গার শাখা হিসেবে পদ্মার উদ্ভব ঘটার সম্ভাব্য কালও একটা নির্ধারণ করেছেন ‘ষোড়শ শতকের পূর্বে গঙ্গানদী গৌড়-নগরের উত্তর ও পূর্ব দিয়ে প্রবাহিত হত এবং সে সময়ে ঐখান থেকেই গঙ্গার পূর্ব-দক্ষিণ বাহিনী পদ্মা শাখার উদ্ভব হয়। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দী থেকে গঙ্গার ভাগীরথী ও পদ্মারূপে দ্বিখণ্ডিতভাব গৌড়নগরের অনেকটা দক্ষিণদিকে ঘটেছে।
বাঙালির আরেক ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ও ভাগীরথীকেই গঙ্গার আদি শাখা বলে মনে করেন, তার বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব গ্রন্থে তিনি এমনকি উইলকক্স-এর ভাগীরথী নদীটি ভগীরথ কর্তৃক খনিত হবার সম্ভাবনাটিকেও অনৈতিহাসিক বলে মন্তব্য করেছে। তবে তার সাক্ষ্য ইতিহাস নয়, পুরাণ গ্রন্থই: ‘রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহই যে যথার্থত ভাগীরথী ইহাই রামায়ন-মহাভারত-পুরাণের ইঙ্গিত, এবং এই প্রবাহের সঙ্গেই সুদূর অতীতের সূর্যবংশীয় ভগীরথ রাজার স্মৃতি বিজড়িত।’
দুই.
‘আমরা দেখেছি আদি-মধ্যযুগে গঙ্গার পূর্বশাখা অর্থাৎ পদ্মানদীর উদ্ভব হয়নি। এমনকি মধ্যযুগেও কোন সময় করতোয়া ও ব্রহ্মপুত্র একযোগে সমুদ্রে পড়ত বলে বোধ হয়। তাই দেখতে পাই প্রাচীন যুগে কামরূপের রাজগণ সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া নৌকায় চাপিয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তেন এবং গঙ্গা বেয়ে বিহারের দিকে চলে যেতেন। ভাস্করবর্মা ২০,০০০ হাজার হস্তী ৩০,০০০ নৌকায় চড়িয়ে ঐরূপে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।’
আমরা এখানে দুটি থেকে যুক্তি লক্ষ্য করছি যার ওপর ভিত্তি করে অনেক নদী গবেষক পদ্মার ধারাটিকে নবীন বলে থাকেন। আবার অনেকেই পদ্মার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও সেটা গঙ্গা বিচ্ছিন্ন একটি ছোট শাখা নদী হিসেবে বর্ণনা করছেন।
তবে নীহাররঞ্জন পদ্মার যে বয়স নির্ধারণ করেছেন, তা পরবর্তীকালের ইউরোপীয় পর্যটকদের চেয়ে অধিক বয়েসী। এই বিষয়ে একই মত কপিল ভট্টাচার্যেরও, নানান ঐতিহাসিক তথ্য থেকে তাদের অনুমান পদ্মা এমনকি আরও উপরের পথ দিয়ে চলন বিল, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ইত্যাদিকেও জড়িয়ে প্রবাহিত হয়েছে আরেকটি কালে; বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী তখন পদ্মারই প্রবাহ ছিল, বর্তমানে তা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের খাতে প্রবাহিত।
তাহলে পদ্মার সৃষ্টি কথন হল? আর সেই পদ্মা কি নিছক একটা শাখা নদী নাকি গঙ্গার শাখা?
এক. ষোড়শ শতকের আগে পদ্মার সাথে গঙ্গার সম্পর্কহীনতা বিষয়ক দীনেশ, ইটন প্রভৃতির ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিলের কল্যাণে। পঞ্চদশ শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝা, নদীয়ার বাসিন্দা ছিলেন তিনি, বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী তার জীবনকাল ১৩৮১-১৪৬১। তিনি ‘রামায়নে’ পদ্মার কথা উল্লেখ করেছেন।
আগে যায় ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া/ কাণ্ডারের প্রতি গঙ্গা মুক্তিপদ দিয়া।
গৌড়ের নিকটে মিলিল আসিয়া।।/পদ্মা নামে এক মুনি পূর্ব্বমুখে যায়।
ভগীরথ বলি গঙ্গা পশ্চাতে গোড়ায়।।/যোড়হাত করিয়া বলিলেন ভগীরথ-
পূর্ব্বদিকে যাইতে আমার নাহি পথ।।/পদ্মমুনি লয়ে গেল নাম পদ্মাবতী।
ভগীরথ সঙ্গেতে চলিল ভাগীরথী।।/শাপবাণী সুরধুনী দিলেন পদ্মারে।
মুক্তিপদ যেন নাহি হয় তব নীরে।।
এই কাহিনীতে আসল প্রবাহ হবার কথা ছিল ভাগীরথীরই, কিন্তু পথে পদ্মামুনি পূর্বদিকে ভুলিয়ে নিয়ে এলেন নদীটিকে। সুরধুনী (গঙ্গার একটি শাখা, আবার গঙ্গার একটি নামও বটে, এখানে দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত) পদ্মাকে অভিশাপ বাণী দিলেন, যেন তার নীড়ে মুক্তিপদ নাহি হয়।
কৃত্তিবাসী এই উল্লেখ কিন্তু দুটো প্রশ্ন ফয়সালা করে, প্রথমত ইটন প্রমুখদের কথিত সময়ের আগেই গঙ্গার সাথে পদ্মার একটা সম্পর্কের একটা স্বীকৃতি এখানে পাওয়া যাচ্ছে, বাতিল হচ্ছে দীনেশচন্দ্র সরকারের যাবতীয় অনুমান। তাদের অনুমান অনুযায়ী এই মিলনটি আরও বহু পরে ঘটেছিল। শুধু যে পদ্মাকে গঙ্গার সাথে যুক্ত দেখেছেন কৃত্তিবাস, তাই নয় ,এগার নিবরে যখন বারতে প্রবেশ/ হেন বেলা পড়িতে গেলাম উত্তরের দেশ।।/ বৃহস্পতিবারের বেলা ঊষা পোহালে শুক্রবার/ বারেন্দ্র উত্তরে গেলাম বড় গঙ্গাপার । এখানে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি বরেন্দ্রভূমি পৌঁছাতে বড় গঙ্গা পাড়ি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, ভৌগোলিক বিচারে এই বড় গঙ্গা পদ্মা, তার রচনায় পুন্যতীর্থ ভাগীরথীরকেই ছোটগঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে পরিস্কার যে, কৃত্তিবাসের কালেই পদ্মা গঙ্গার অধিকাংশ জল নিষ্কাষণ করছিল।
সিয়ার-আল-মুতাক্কিরিন এ লিপিবদ্ধ হয় যে, করতোয়া গঙ্গার তিনগুণ ছিল যখন বখতিয়ার খিলজি ১১১৫ সালে বাংলার উত্তরাঞ্চল দখল করেন।এখানে একটি বিষয় খুব ভাল করে বুঝতে হবে। গঙ্গা প্রাচীন কালে করতোয়ার চেয়ে অনেক বড় নদী ছিল; এখনো বটে। করতোয়া আগে বিশাল বিপুলা ছিল বটে, তবে সেটা গঙ্গার ন্যায় না। তাহলে বইয়ে উল্লেখ করা নদীটি সম্ভবত পদ্মা, যার দৈর্ঘ্য পূর্বে করতোয়ার চেয়ে অনেক কম ছিল।
এবার আমরা আরো প্রাচীন নিদর্শনের দিকে তাকাব। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের বাঙালী লেখক ভুসুকু পা প্রথম ‘পদ্মা খালে’র কথা উল্লেখ করেছিলেন। ‘বাজলার পাঁড়ী, পঁ-উ-আ খালে বাঁহিউ’ অর্থাৎ পদ্মাখালে বজরা নৌকা পাড়ি দিতেছে। ভুসুকু পা’র আসল নাম ছিল শান্তিদেব। তিনি ধর্মপালের সময় বর্তমান ছিলেন। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে শান্তিদেব ভুসুক সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে ভুসুকুর জীবিৎকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। এই প্রথম কোন বাঙালী লেখকের বিবরণে পদ্মার নাম পাওয়া গেল। এর থেকে বোঝা যায় যে পদ্মার অস্তিত্ব সপ্তম শতকেও ছিল তবে সেটি আকারে ছোট ছিল।
প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে বিশ্বখ্যাত ভূগোলবিদ টলেমি যে মানচিত্র একেছিলেন সেখানে গঙ্গার সমুদ্রগামী পাঁচটি খাতের কথা উল্লেখ আছে। জেমস টেলরের বর্ণনায় পদ্মা ঢাকার শ্রীপুরের মফলৎগঞ্জ ও রাজনগরের কিছুটা উত্তর দিয়ে প্রবাহিত। এটাই গঙ্গার প্রধান শাখা যা প্রশস্ততা ছিল ২/৪ মাইল।
যারা ভাগীরথীকে গঙ্গার মূল প্রবাহ প্রমাণে ব্যস্ত তারা মূলত মহাভারতের কিছু উদাহরণের আশ্রয় নেয়। মধ্যপুরাণ ও মহাভারতে গঙ্গার পূর্বগামী ৩টি ধারা হলদিনী, পাবনী ও নলিনীর, উল্লেখ রয়েছে। অনেকের ধারণা পাবনী থেকে পদ্মার নাম এসেছে যা পাবনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার পদ্মার প্রাচীন নাম হল ‘নলিনি’। পদ্মর আরেক নাম নলিন। পদ্ম-নলিন, পদ্মা-নলিনি, এভাবেও হিসাব করা যেতে পারে। অর্থাৎ পদ্মার গতিপথ নবীন নয় বরং অনেক পুরাতন। জন্ম অবধি এটি গঙ্গার জল বয়ে নিয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরে।
দুই. প্রাচীন যুগে কামরূপের রাজাগণ সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া নৌকায় চাপিয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়া এবং গঙ্গা বেয়ে বিহারের দিকে চলে যাওয়ার ঘটনা পদ্মার অনুপস্থিতি কিংবা গঙ্গা বিচ্ছিন্নতার কারণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট না। সে সময় বঙ্গের এই অংশে অনার্য রাজাদের আবাস ছিল। আর তাই আর্যগন এই পথ পরিহার করতেন। যদিও সেসময় ভাস্করবার্মা আর হর্ষবর্ধনের প্রধান শত্রু শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের পতন হয়। আবার হতে পারে পদ্মা সেই সময় খুব বড় কোন নদী ছিল না। ভুসুকুপার বর্ণনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এবার সাহিত্য বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক বিচারে ঘটনাটিকে দেখা যাক। নীহাররঞ্জন কামরূপরে রাজাদের ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পাড়ি দেওয়ার উদাহরন নিছক গল্প ছাড়া কিছু্ই না। মহাভারতে ব্রহ্মপুত্রের নাম লৌহিত্য। বর্তমান সময়ের আসামের কিছু অংশ, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ নিয়ে তখন কামরূপ গঠিত হয়েছিল। পুরো সিলেট আর ময়মনসিংহের একটা বড় অংশ প্রাচীন কালে একটি সাগরের নিচে ছিল। এই সাগরের নাম কেউ বলে ‘কালিদহ সাগর’; কেউ বলে ‘লৌহিত্য সাগর’ আর টলেমি বলছে এ্যান্টাবোল সাগর। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গবেষকদের মতে এই সাগরের নাম কালিদহ সাগর আর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গবেষকদের মতে এই সাগরের নাম লৌহিত্য সাগর। জনবসতি শুরু হওয়ার পর থেকে এই হাওরাঞ্চল দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ ময়মনসিংহ অঞ্চল প্রাচীন কালে কোচদের স্বাধীন রাজ্য ছিল অপর দিকে বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল খাসিয়াদের দখলে ছিল।এই দুই অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচার, ভাষা ইত্যাদি বর্তমানেও দুইরকম। হয়তবা এ কারণেই দুই অঞ্চলে এই সাগর দুই নামে পরিচিত হয়েছে। কালিদহ কিংবা লৌহিত্য যাইহোক না কেন এই অঞ্চল সমূহ এক সময় সাগর গর্ভে নিমজ্জিত ছিল সে বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারন হাওরাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এই অঞ্চল এক সময় বিশাল সাগরে নিমজ্জিত ছিল। হট্টাথের পাঁচালী হতে অনুমান করা হয় শ্রীহট্টের বিস্তৃত সমতল ও নিম্ন ভূমি সকল অর্থাৎ শ্রীহট্টের দক্ষিনাংশ, দক্ষিণ শ্রীহট্টের পশ্চিমাংশ, করিমগঞ্জ হাকালুকি প্রভৃতি অংশ বিশেষ হবিগঞ্জের উত্তরাংশ এবং প্রায় সমূদয় সুনামগঞ্জ তৎকালে অনেকটা জলতলে ছিল। সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে চুনা পাথর ও একধরনের ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবালদ্বারা সৃষ্ট। এগুলো থেকে সাগরের বিস্তৃতি বিষয়ে ধারনা করা হয়। ঐতিহাসিক হান্টার সাহেব এবং ঐতিহাসিক ভ্রমনকারী হামিলটন সাহেবের বর্ণনা হতেও এ বিষয়টি জানা যায়। ৬৪০ সালে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন্থ সাং ষ্টীমার যোগে এই অঞ্চল সমূহের উপর দিয়েই কামরুপের রাজা কুমার ভাষ্কর বর্ম্মার আমন্ত্রণে কামরূপ আগমন করেছিলেন।
তাহলে কামরূপের রাজাগণ ব্রহ্মপুত্র যোগে যে সমুদ্রে নামতেন সেটা বঙ্গোপসাগর নয় বরং সেটা ছিল ‘লোহিত্য সাগর’; যেখানে লোহিত্য এসে পড়ত। অবশ্য এই কালিদহ, লোহিত্য কিংবা এ্যান্টাবোল সাগর বঙ্গোপসাগরের উত্তর অংশ ছিল । গঙ্গা নদীর মোহনা লোহিত্য সাগর আর বঙ্গোপসাগরকে পৃথক করেছিল কারণ টলেমির মানচিত্রে গঙ্গা এ্যান্টাবোল দিয়ে প্রবাহিত। অর্থাৎ গঙ্গার আদি ধারার সাথে ব্রহ্মপুত্রের কোন মিল ছিল না এবং দুটি নদীর মোহনাই ছিল আমাদের আলোচ্য লোহিত্য সাগর। এখানে পদ্মা হীনতার কোন প্রমাণ মিলছে না বরং গঙ্গার প্রধান ধারা বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রবাহের প্রমাণ শিলছে। তাই সমুদ্র থেকে পুনরায় গঙ্গা যাত্রা, গঙ্গার পদ্মা খাতে প্রবাহের যথার্থ প্রমাণ বহন করে। তবে সেটা হয়তবা গঙ্গা নামেই। খাত পরিবর্তন করে পদ্মা বর্তমান খাতে এসে প্রবাহিত হচ্ছে।
সত্যি বলতে পদ্মা নামের/খাতের প্রাচীনতা নিয়ে গবেষণা করা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হওয়া উচিত ‘গঙ্গা কি প্রচীন কালে ভাগীরথী দিয়ে কলকাতার পাশ দিয়ে সমুদ্র যাত্রা করত নাকি বর্তমান বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার মূল ধারা প্রবাহিত হত’। আমরা দেখেছি প্রাচীন কাল থেকেই গঙ্গা সমুদ্র যাত্রার জন্য বাংলাদেশ অংশে নিজের বেশির ভাগ জল উজার করে দিয়েছে। এবার আমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ গঙ্গার আদি খাত নিয়ে আলোচনা করব।
গঙ্গার আদি খাত কোনটি? ভাগীরথী নাকি পদ্মা?
প্রথমে গঙ্গার কয়েকটি প্রচীন খাতের বিবরণ দেখব আমরা।
১*রেনেল ও ফ্যানডেন ব্রকের নকশায় দেখা যায় ষোড়শ শতকে পদ্মা বেগবতী নদী। সিহাবুদ্দিন তালিশ (১৬৬৬), মির্যা নাথনের (১৬৬৪) বিবরণীতে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমে ইছামতির উল্লেখ করেছে। ইছামতির তীরে যাত্রাপুর এবং তিন মাইল উত্তর পশ্চিমে ডাকচড়া (মানিকগঞ্জ) এবং ঢাকার দক্ষিণে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলন প্রবাহের সমুদ্র যাত্রা। ড. নীহাররঞ্জন বলেন, ‘তখন গঙ্গার এ প্রবাহে পদ্মার নামকরণ দেখছি না। ‘আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আবুল ফজল লিখেছেন (১৫৯৬-৯৭), ‘কাজীর হাটের কাছে পদ্মা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে একটি শাখা পূর্বগামিনী পদ্মাবতী নাম নিয়ে চট্রগ্রামের নিকট সমুদ্রে মিশেছে।’ মির্যা নাথানের বর্ণনায় করতোয়া বালিয়ার কাছে একটি বড় নদীতে পড়েছে। এই বড় নদীটির নাম পদ্মাবতী।
২*চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা (১৩৪৫-৪৬) চীন দেশে যাওয়ার পথে চট্রগ্রাম নেমেছিলেন। তিনি চট্রগ্রামের হিন্দু তীর্থস্থান গঙ্গা নদী ও যমুনা নদীর সঙ্গমস্থল বলেছেন। তাতে বোঝা যায় চতুর্দশ শতকে গঙ্গার মধ্যবর্তী প্রবাহ পদ্মা চট্রগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তটভূমি প্রসারের সাথে সাথে চট্রগ্রাম এখন অনেক পূর্ব দক্ষিণে সরে গিয়েছে। ঢাকাও এখন পদ্মার উপর অবস্থিত নয়। পদ্মা এখন অনেক দক্ষিণে নেমে এসেছে। ঢাকা একন পুরাতন গঙ্গা পদ্মার খাত বুড়িগঙ্গার উপর অবস্থিত আর পদ্মা ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দের অদূরে। পদ্মা তার খাত বারবার পরিবর্তন করেছে তার যথেষ্ট প্রমাণাদি এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। দশম শতকের শেষে এবং একাদশ শতকের গোড়ায় চন্দ্রবংশীয় রাজারা বিক্রমপুর, হরিকেল অর্থাৎ পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেকটা জুড়ে রাজত্ব করতেন। এই বংশের মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র তার ইদিলপুর পট্রলীদ্বারা স্মতট পদ্মাবতী অঞ্চলের অন্তর্গত কুমার তালক মন্ডলের জনৈক ব্রাহ্মণকে একখন্ড ভূমি দান করেছিলেন। পট্রলীও সমসাময়িক সাহিত্য গ্রন্থেও পদ্মা নদীর উল্লেখ আছে।
৩* ব্রহ্মপুত্র বর্তমান যমুনার খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করার আগে পদ্মা ধলেশ্বরী বুড়িগঙ্গার খাতে প্রবাহিত হত। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিস্তা অকস্মাৎ তার পূর্ব যাত্রা পরিত্যাগ করে এবং তার বিপুল বন্যার বারিরাশি ব্রহ্মপুত্রের বন্যার পানির সঙ্গে মিশে যমুনার খাতে বইতে শুরু করে দেয় গোয়ালন্দের পাড়ে। প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরের মন্দির প্রাসাদ ধবংস করে পদ্মা কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে। জেমস টেলরের বর্ণনায় কীর্তিনাশা ঢাকার শ্রীপুরের মফলৎগঞ্জ ও রাজনগরের কিছুটা উত্তর দিয়ে প্রবাহিত। এটাই গঙ্গার প্রধান শাখা যা প্রশস্ততা ছিল ২/৪ মাইল। রেনেলের মানচিত্রে টেলরের বর্ণনায় কীর্তিনাশা কার্তিকপুরের উত্তরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। গঙ্গার দ্বিতীয় শাখা টেলরের বর্ণনায় নয়াভাঙ্গনী নদী (আড়িয়াল খাঁ) ঢাকা জেলার কোল বেয়ে বাকেরগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। মূলতঃ ৩০০/৪০০ বৎসর পূর্বে পদ্মার ধারা বর্তমান ধারা থেকে আরো উত্তরে বোয়ালিয়া (রাজশাহী শহর) পাবনার চলনবিল, ইছামতি (মানিকগঞ্জ) ধলেশ্বরী একাকারে ঢাকার দক্ষিণ দিয়ে শ্রীপুরের কীর্তিনাশা হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হত। ২০০ থেকে ২৫০ বছরের মধ্যে পদ্মা অনেক দক্ষিণে সরে এসে বর্তমান খাতে রাজবাড়ি জেলার কোল ঘেঁষে জেলার উত্তর সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এবার আমরা দেখব গঙ্গার আদি খাত পদ্মা নাকি ভাগীরথী। খ্যাতিমান ভারতীয় নদীপ্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য ও সেচপ্রকৌশলী উইলিয়াম উইলকক্স মনে করেন, গঙ্গার আদি খাত পদ্মাই। ভাগিরথী তাঁদের মতে গঙ্গা-পদ্মা থেকে কেটে আনা খাল ছাড়া আর কিছুই না। কপিল ভট্টাচার্য থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক: ‘বাংলাদেশের মানুষের মনের সংস্কার কিন্তু ভাগীরথীকেই গঙ্গার প্রধান প্রবাহ খাত বলে মনে করে। হিন্দু সভ্যতায় গঙ্গা মাহাত্ম্যের প্রচারণা এই ভাগীরথীকেই গঙ্গা বলে প্রচার করেছে। উইলকক্স সাহেবের পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক ও ইঞ্জিনিয়ারেরাও ১৯২৮ খৃস্টাব্দের পর বলতে চেয়েছেন, ভাগীরথীই গঙ্গার প্রথম মুখ্য খাত… কিন্ত ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা ভাগীরথীর গঙ্গার প্রধান খাত হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ আনে। তারা বলেন, ভাগীরথী-হুগলীর নিম্নাংশ প্রথম থেকেই সমুদ্রের খাঁড়ি ছিল। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ও বিহারের গাঙ্গেয় উপত্যকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক গাঙ্গেয় পলিস্তরের নিচে যে হরিদ্রাভ লাল কংকর প্রস্তর মিশ্রিত মৃত্তিকার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, হিমালয় পর্বত থেকে আজকের এই বিপুলায়তন গঙ্গা সম্পূর্ণ অবতরণ করবার আগে এখানকার সাগরগর্ভ মধ্যপ্রদেশ ও ছোটনাগপুরের পার্বত্য উপত্যকায় উৎপন্ন প্রাচীন বিশালায়তন নদীর জলধারায় বাহিত পলির দ্বারাই পূর্ণ হয়েছিল। দামোদর প্রভৃতি প্রাচীন সংস্করণ নদ-নদীর পলি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভাগীরথী উপত্যকার নিম্নতম স্তর গঠিত। সুতরাং গঙ্গা অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই বর্তমান পদ্মার প্রবাহপথে প্রবাহিত হত, অথবা ভাগীরথীর পথে প্রবাহিত হত, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে সমস্ত গঙ্গা-পদ্মা ও ভাগীরথীর খাতে গভীর নল পুতে ওই হরিদ্রাভ লাল মাটির ঢাল (slope) পরীক্ষা করতে হবে।’
এভাবে কপিল ভট্টাচার্যের যুক্তি অনুযায়ী বাংলা বদ্বীপের পশ্চিমাংশের ভূমি গঠিত হয়েছে গঙ্গা নদীরও জন্মের পূর্ববর্তী ছোটনাগপুর বিধৌত নদীসমূহ দিয়ে এবং পশ্চিমাংশের সমুদ্রঅভ্যন্তরে বেশিদূর বৃদ্ধি ভাগীরথী শাখার প্রাচীনত্বের কারণে অতিরিক্তকাল পলিসঞ্চয় নয়। পশ্চিমাংশের ভূভাগ প্রাচীন বটে, তবে তা ছোটনাগপুরের পাথুড়ে শিলাদ্বারা গঠিত। গঙ্গাবাহিত পলি দিয়ে প্রধানত গঠিত হয়েছে কেবল দ্বীপের পূবভাগেরই একটি অংশ। ফলে আদি¯স্রোত বিষয়ক ধারণাটি আর মীমাংসিত থাকে না।
যায় হোক এবার আমরা শেষ কথাতে আসি। পদ্মাই গঙ্গার আদি খাত-এই কথা বলতে আর কোন দ্বিধা থাকে না। কারণ টলেমি গঙ্গা নদীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় প্রাচীন গঙ্গা নদী প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান গোয়ালন্দ থেকে অনেক উত্তরে ঢাকা ভাওয়ালের পাশে ‘এ্যান্টিবোল’ হয়ে প্রবাহিত হতো। তখন ঐ অঞ্চলকে ‘এ্যান্টিবোল সাগর’ বলে পরিচিতি রয়েছে (জেমস টেলর)। জনশ্রতি ও ঐতিহাসিক বিবরণে সেখানে কালিদহ আর লোহিত্য নামের দুটি সাগরের নাম পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে চুনা পাথর ও একধরনের ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবালদ্বারা সৃষ্ট। এগুলো থেকে সে অঞ্চলে সমুদ্রের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তৎকালীন সময়ে গঙ্গার উত্তর হতে সরাসরি দক্ষিণে করতোয়ার দক্ষিণাংশ এ অঞ্চলের হড়াই নদী বলে পরিচিতি ছিল। এ নদী খুবই বেগবান ছিল। আমরা যদি উপমহাদেশের বড় বড় নদী সমূহের গতিপথ পর্যবেক্সন করি তাহলে দেখব যে, নদী সমূহ সমুদ্র যাত্রা কালে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভাগীরথী পদ্মার চেয়ে উচ্চ স্থানে প্রবাহিত। আর তাই ভাগীরথীকে মূল খাত/আদি খাত মনে করার কোন কারণ নাই। পদ্মার মোহনার দুই পাশের ভূমি অপেক্ষকৃত উচুতে অবস্থিত। প্রাচীন মানচিত্রে আমরা দেখি যে পূর্বে চট্টগ্রাম আরো পশ্চিমে ছিল। পলি পড়ে পদ্মা খাত সংকীর্ণ হলে গঙ্গা খাত পরিবর্তন করতেই পারে। গঙ্গা বার বার খাত পরিবর্তনের ফলে হয়ত কোন এক সময় ভাগীরথী দিয়ে মূল প্রবাহ প্রবাহিত হত, কিন্তু সেটা আদি কিংবা চিরন্তন না।
প্রাকৃতিক নিয়মে গঙ্গা পদ্মার খাত ছেড়ে হয়ত কোন এক সময় ভাগীরথীর পথে প্রবাহিত হত। কিংবা ভাগীরথ কর্তৃক ভাগীরথী খাল খননের পর গঙ্গা তা খাত পরিবর্তন করে ভাগীরথীর পথ অবলম্বন করে। পরে আবার গঙ্গা ভৈরব, জলঙ্গি, মাথাভাঙ্গা,কুমার,গড়াই প্রভৃতি পথ পরিহান করে পদ্মায় ফিরে আসে।
ফারাক্কা বাঁধঃ
ভাগীরথী-হুগলীর নাব্যটা সঙ্কট মেটানোর জন্য ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাধঁ চালু করে। এতে বাংরাদেশের নদ-নদী গুলি শুকিয়ে মরতে বসেছে। উত্তরাঞ্চল, বিশেষত বরেন্দ্র ভুমি আজ মরুভুমিতে পরিণত হবার প্রহর গুনছে। পানির স্তর অনেক কেমে গেছে। আমাদের চারঘাটে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলনের ফলে আর্সেনিক ছড়াচ্ছে এই অঞ্চলে। ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি হয়েছে তবে বাংলাদেশ তার নায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। ভারত জুড়ে গঙ্গা কেন্দ্রিক সেচ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ একেবারে কমে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ পানির নায্য হিস্যা পাচ্ছে না।
সাপ্তাহিক একতা পত্রিকায় গত ২৬ মার্চ, ২০১৭ তারিখে সাইফুল ইসলামের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে ফারাক্কা বাধেঁর পুরো বিষয়টি। নিচে সেটি হুবহু প্রকাশ করা হল।
সাইফুল ইসলাম : ভাটির দেশ বাংলাদেশ। হিমালয় পর্বতশ্রেণিতে উদ্ভূত নদীগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই এসে মিশেছে সমুদ্র। ভাটির দেশ হওয়ায় উজানের দেশগুলোর যে কোনো নদী শাসন ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গঙ্গার বুকে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় হুগলি নদীতে পলির আস্তরণ জমতে থাকে ব্রিটিশ সরকারের শাসনামল থেকেই। এ পলি পরিষ্কার ও কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কিভাবে হুগলির দিকে ফেরানো যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৮৫১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত: পাঁচটি সমীক্ষা চালানো হয়। এরপর ব্রিটিশ চলে গেলে, এ চিন্তাভাবনার দায়ভার বর্তায় ভারত সরকারের ওপর। শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয় ফারাক্কা বাঁধ। পশ্চিমবঙ্গের এক সময়কার চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বলেন- ১. গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না। ২. গঙ্গা ও ভাগিরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালণ কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজে নেবে। ৩. প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা জুড়ে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। ৪. ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতিশক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরণের নদীর গতিপথ আঁকা-বাঁকা। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগিরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগিরথী ও উজানে বিহার পর্যন্ত সবগুলো নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ওইসব নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন ও চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে। ৫. ভাটি অঞ্চলের সব নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। ৬. শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনেরও আশঙ্কা রয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কপিল ভট্টাচার্যের সবগুলো আশঙ্কাই এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। ২ হাজার ২৪০ মিটার (৭ হাজার ৩৫০ ফুট) লম্বা বাঁধটি তৈরি হয়েছিল ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ে। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহায়তা বাঁধের নির্মাণ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। ওই বছরেরই ২১ এপ্রিল থেকে চালু হয় বাঁধটি। ফারাক্কার বর্তমান অস্তিত্বের শুরুটাই হয়েছিল একটা মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে। ৪১ দিনের জন্য চালু হওয়া বাঁধ এখন চালু রয়েছে ৪২ বছর ধরে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয়, শুষ্ক মৌসুমে অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে ফারাক্কা পয়েন্টে (ব্যারাজের ভাটিতে) ৪৪ হাজার কিউসেক পানি (১ কিউসেক = প্রতিসেকেন্ডে প্রবহমান এক ঘনফুট পানি) পাবে বাংলাদেশ। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ৩১ মে। দুই দেশের মধ্য একটি সমঝোতা ছিল যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিতে সই না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানেলটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানায় ভারত। ওই বছরের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড গঙ্গার প্রবাহ প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশের অনুমতি দাবি করে। বাংলাদেশও এতে সায় দেয়। ভারত বাঁধ চালু করে এবং নির্ধারিত সময়ের পরেও একতরফাভাবে গঙ্গার গতি পরিবর্তন করতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের দিকেও তা একতরফাভাবে চালু থাকায় বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক সর্বসম্মত বিবৃতির মাধ্যমে সমস্যার ন্যায্য ও দ্রুত সমাধানের জন্য ভারতকে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক দফায় আলোচনার পর ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর শুষ্ক মৌসুমে পানি বণ্টন নিয় দুই দেশের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি (১৯৭৮-৮২) একটি চুক্তি সই হয়। এরপর ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে ভারতের সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। কিন্তু ১৯৮৯-৯৬ পর্যন্ত গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। ওই সময়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফারাক্কায় বাঁধ পড়ার আগে প্রতি বছরের মার্চে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে যেখানে গঙ্গার (পদ্মা) প্রবাহ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৯৮০ কিউবিক মিটার, ১৯৯৩ সালের একই সময়ে তা নেমে আসে মাত্র ২৬১ কিউবিক মিটারে। এরপর ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি একটি পানি বণ্টন চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে দুই দেশ তা সমানভাগে ভাগ করে নেবে। পানি প্রবাহ ৭০-৭৫ হাজার কিউসেক হলে সেখান থেকে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক ও অবশিষ্টাংশ পাবে ভারত। পানি প্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক এবং অবশিষ্ট বাংলাদেশ। এ চুক্তিটি বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশে পদ্মাসহ এর শাখানদীগুলোর জলজ ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। গঙ্গার প্রবাহ কমায় পলি জমে নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষায় যখন ফারাক্কার সবগুলো স্লুইস গেট খুলে দেয়া হয়, সারা দেশে দেখা দেয় তীব্র বন্যা। গত বছরও দেখা গেছে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বন্যার সময় বসতভিটা নষ্ট হয়ে পড়াসহ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়ে মানুষ। নষ্ট হয়ে যায় আবাদি ফসল, প্রাণ যায় গবাদিপশুর, এ সব কিছুতেই রয়েছে ফারাক্কার নেতিবাচক ভূমিকা। ফারাক্কায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিরূপ প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, কৃষি, লবণাক্ততা, নৌপরিবহন, মৎস্য ও বনজসম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বাঁধটির কারণে দেশের গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে চলছে মরুকরণ। বিনষ্ট হতে চলেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি। শুকনো মৌসুমে উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে ভাটিতে বাংলাদেশে পদ্মার প্রবাহ কমে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। একই সঙ্গে ভরাট হয়ে পড়ে নদীর তলদেশ। অথচ কৃষিতে পানি প্রয়োজন। ফলে এ সময় কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানি গভীর নলকূপ দিয়ে ওই নেমে যাওয়া স্তর থেকেই টেনে এনে ব্যবহার করতে হয়। গভীর থেকে টেনে আনা এসব পানি মাটির নিচ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতু, যা হয়ে উঠছে জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। গত দশকে দেশের জনস্বাস্থ্যে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার প্রভাব এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে আখ্যা দেয় ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণবিষপ্রয়োগ’ হিসেবে। মনুষ্যসৃষ্ট এ দুর্যোগ চালু রয়েছে এখনো। পদ্মা ও তার শাখা প্রশাখাগুলো এখন আগের তুলনায় নাব্যতা হারিয়েছে অনেকাংশেই। ফারাক্কার কারণে এখন শুকিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় অনেক ছোট ছোট নদী। গড়াই, মধুমতির মতো এককালের প্রমত্তা নদী শীতের সময় ক্ষীণ ধারায় পরিণত হয়। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদে আধার সুন্দরবন গড়ে উঠেছে নদী ও সাগরের সঙ্গমস্থলে নোনামিঠা পানির মিশ্রণের (ব্র্যাকিশ) ওপর। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজানি মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়া এখানকার জলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় অত্যাধিক, যা সুন্দরবনের শ্বাসমূলজাতীয় উদ্ভিদের জন্য হানিকর প্রমাণিত। কিছুদিন পরই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে চালু হতে যাচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। একদিক থেকে ফারাক্কা, অন্যদিক থেকে রামপাল; এ দুই মধূ-কৈটভে এবার সুন্দরবনটাকে নিশ্চিত গিলেই খেতে যাচ্ছে। আসলেই মানুষের চেয়ে নির্বোধ প্রাণী আর হয় না। ফারাক্কা গঙ্গা-পদ্মার জলজ সম্পদের ওপরেও ফেলছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। বাঁধটির কারণে এর দুপাশের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ একে অপরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে একই সঙ্গে এসব মৎস্য ও প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে প্রজনন ক্ষেত্রও। নদীর ডলফিন শুশুকের বিপন্নতার মূলে ফারাক্কার অবদান কম না। কয়েক বছর আগে শুধু ফারাক্কার কারণে প্রত্যক্ষ ক্ষতির হিসাব করা হয়েছিল ৩০০ কোটি ডলার। পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব করলে এ ক্ষতির হিসাব যে কততে দাঁড়াবে, তা বলা মুশকিল। অথচ এ বাঁধ যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষতি করছে, তা নয়। ভারতকেও পোহাতে হচ্ছে এ শ্বেতহস্তি পোষার খেসারত। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক আর জলবায়ু পরিবর্তন কখনো কোনো দেশের সীমানা মেনে থাবা বসায় না। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় হুগলী-ভাগিরথীতে বিশাল জলবদ্ধতা সৃষ্টি করছে ফারাক্কা। এতে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়েছে। একই সঙ্গে বিস্তার লাভ করেছে ম্যালেরিয়ার মত প্রাণঘাতি রোগ। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে নদী ভাঙ্গণের কারণে চর জাগার পরিমাণ বেড়েছে অনেক। প্রতি বছর মালদহে নদীর তলদেশ বাড়ছে ৫০ সেমি হারে। মানিক চাক ঘাটের কাছে গঙ্গার গভীরতা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ ফুটে। এতে পানি প্রবাহ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়ে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বন্যার সময় কালিন্দি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মহানন্দা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। বিহারে এখন প্রতি বছর বন্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধকেই দায়ী করা হচ্ছে। প্রদেশটিতে শুধু গত বছরের বন্যাতেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ২০ লাখ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে নালিশও জানিয়েছেন। মোদিও তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস জানিয়েছেন। অবিশ্বাস্যভাবে, ওই সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আবার সোচ্চার হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ থাকলেও, এ বিষয়ে মুখ খুলতেই চায়নি ঢাকা। ফারাক্কা আসলে যতটা বাঁধ, তার চেয়ে অনেক বড় ফাঁদ। এ পাতা ফাঁদে বাংলাদেশ তো পা দিয়েছেই, এখন ভারত নিজেও তাতে আটকাতে যাচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে। এখন ভারতেরও সময় এসেছে বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার, তাতে সবারই মঙ্গল।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ
গঙ্গা, পদ্মা, পদ্মাবতী-মাহাবুব সিদ্দিকী
উইকিপিডিয়া
বাংলা পিডিয়া
ফিরোজ আহমেদ; ওমকার ব্লগ
#নিরিবিলি
পদ্মাঃ
উৎসঃ হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী উপত্যকা
মোহনাঃ বঙ্গোপসাগর
হিমালয়ের গাঙ্গেত্রী উপত্যকা থেকে জন্ম নিয়ে গঙ্গা হরিদ্বারের নিকট এসে সমতল স্পর্স করেছে। আসলে গাঙ্গেত্রী উপত্যকা থেকে বয়ে আসা জলধারা/নদীটি ভাগীরথী নামে পরিচিত। এটিকে গঙ্গার উৎপত্তি স্থল বলা হলেও মূল গঙ্গার জন্ম মূলত ভাগীরথী আর আলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল থেকে। এখানে আলকান্দা ভাগীরথীর চেয়ে অনেক বড় নদী। অলকানন্দার উৎসস্থল নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট শৃঙ্গের বরফগলা জল। গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলি ছোট নদী। এর মধ্যে ছটি দীর্ঘতম ধারা এবং গঙ্গার সঙ্গে তাদের সঙ্গমস্থলগুলিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করে। এই ছটি ধারা হল অালকানন্দা, ধৌলীগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মান্দাকিনী ও ভাগীরথী। পঞ্চপ্রয়োগ নামে পরিচিত পাঁচটি সঙ্গমস্থলই অলকানন্দার উপর অবস্থিত।
ছবিতে আলকানন্দা আর ভাগীরথীর সঙ্গমস্থল দেখানো হয়েছে। ডান পাশের নদীটি আলকানন্দা আর বাম পাশের নদীটি ভাগীরথী। গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের কিছু পূর্বে তার প্রধান শাখা নদী ভাগীরথীর জন্ম দেয়। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকাসা ও দুর্লভপুর ইউনিয়ন দিয়ে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়েে এসে নদীটি ইউসুফপুর ইউনিয়ন (শাহপুর) দিয়ে আমাদের চারঘাট উপজেলায় প্রবেশ করে। এটি বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম/দীর্ঘতম নদী; বাংলাদেশ অংশে দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিঃমিঃ। মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪০০ কিঃমিঃ। প্রায় ২২০০ কিঃমিঃ পথ পরিক্রমার পর পদ্মা গোয়ালন্দের নিকট ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সাথে মিলিত হয়েছে। এরপর মিলিত ধারা পদ্মা নাম নিয়ে চাঁদপুরের কাছে বঙ্গোপসাগরের খাড়ির কাছাকাছি এসে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে। অতপর মিলিত ধারা মেঘনা নাম শাহবাজপুর চ্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ‘গঙ্গার’ উল্লেখ্য উপনদী গুলি হল যমুনা, ঘর্ঘরা, গোমতী, শোন, গণ্ডক, কোশী ( কৌশিকী ),মহানন্দা ইত্যাদি। বাংলাদেশ অংশে পদ্মার উপনদীর মধ্যে মহানন্দা ও যমুনা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ অংশে গড়াই (মধুমতি) পদ্মার প্রধান শাখা নদী। এছাড়াও আড়িয়ার খাঁ, কুমার, মাথাভাঙ্গা, বড়াল, চন্দনা, পাগলা, ভৈরব, নারদ ইত্যাদি পদ্মার প্রধান শাখা নদী। বড়াল পদ্মার বাম তীরের প্রধান শাখা নদী। গঙ্গা কেন কোথায় এবং কিভাবে ‘পদ্মা’ নাম ধারণ করেছে তা নিয়ে এখনো নদী বিজ্ঞানীগণ কোন সুরাহা করতে পারেনি। তবে চারঘাটের নিকট এসে গঙ্গা পদ্মা নাম ধারণ করেছে এটা নির্দিধায় বলতে পারি। কারণ ১৬৬০ সালের ম্যাপে আমরা দেখতে পায় যে চারঘাটের নিকটে এসে মহানন্দা গঙ্গার সাথে চূড়ান্তভাবে মিলিত হচ্ছে। এরপর একটি ধারা পূর্ব দিক বরারবর ‘গঙ্গা’ নাম নিয়ে চলন বিলের দিকে প্রবাহিত থাকে। আর আরেকটি ধারা ‘পদ্মা’ নাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। চলন বিলের ধারাটি আসলে আজকের বড়াল নদী যা নাকি এক সময় গঙ্গা নামে প্রবাহিত হত। এই ধারাটি ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে ‘শীতলক্ষ্যা’ নদীকে ধারণ করে মেঘনা নদীর সাথে মিশে চট্রগ্রামের নিকট দিয়ে বঙ্গপসাগরে পতিত হত। ভৈরবের নিকট মেঘনার ঐ অংশ তখন প্রমত্তা ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে পরিচিত ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণের ধারাটি নানা পথ ঘুরে ফরিদপুরের নিকট দিয়ে পদ্মাবতী নামে পতিত হত। মধ্যযুগের প্রথমে এই ‘পদ্মাবতী’র অস্তিত্ব বর্তমান ছিল বলে গবেষকরা একমত হয়েছেন। চারঘাট থেকে গঙ্গার সেই দক্ষিণমুখী ধারায় যে পদ্মবতী সেটা নিয়ে কারো বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। ধারণা করা হয় যে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই ধারাটি ক্ষীণ ছিল। চর্যাপদে তাই ‘পদ্মা খাল’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আর প্রায় ৫০০ বছর আগেই এই ধারাটি গঙ্গার মূল ধারায় পরিণত হয়। পশ্চাদশ দশকের কবি কাশিরাম দাস তাঁর মহাভারতে তাই এই ধারাকে ‘বড় গঙ্গা’ বলেছেন। পুরো বিষয়টাকে এক কথায় বললে এটাই দাঁড়ায় যে চারঘাটের নিকট এসে গঙ্গা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ‘পদ্মা’ আর আরেকটি ধারা ‘গঙ্গা’ (বড়াল) নামে প্রবাহিত হত।
শীতে পদ্মায় অতিথির পাখির আগমন ঘটেছে থানাপাড়া, সারদা |
আরো দেখুন: চারঘাটের নারদ নদ
চারঘাটের মুসা খান নদ
আমাদের চারঘাটের পদ্মাঃ
পদ্মাকে যদি চারঘাটের হৃদপিণ্ড বলি তাহলে বিন্দু মাত্র ভুল হবে না। এটি চারঘাটের অর্থনীতির মূল বাহক। বর্তমানে পদ্মা তার জৌলুস হারিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে পদ্মার এই দুরাবস্থা। এককালে পদ্মায় বড় বড় স্টীমার চলত। পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠেছিল স্টীামার ঘাট ও থানা ঘাট । নওয়াবী আমল থেকে পদ্মার পাড় ঘেষা চারঘাট বন্দর দিয়ে কলকাতা, ঢাকা, নাটোর ও রাজশাহীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা হত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক গবেষণা করে দেখেছেন যে, পদ্মার কারণেই চারঘাটের আমের অমৃত সম স্বাদ। পদ্মার প্রাচীন নাম ‘নলিনী’। মহাকবি কৃত্তিবাস পদ্মাকে বড় গঙ্গা বলে অবিহিত করেছেন। পদ্মা নামের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় বাংলার প্রথম সাহিত্যকর্ম ‘চর্যাপদে’। আর আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’তে প্রথম পদ্মা নদীর নামের উল্লেখ আছে। কোন এক সময় পদ্মা চলন বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত। পদ্মার সেই খাতটি বর্তমানে নারদ নামে পরিচিত। পদ্মা বার বার খাত পরিবর্তনের জন্য খ্যাত। পদ্মা পূর্বে আরো প্রায় ১০ কিঃমিঃ দক্ষিণে ভগবানগালার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের নিকট বঙ্গোপসাগরে পতিত হত। ‘পাগলা, বড়াল, গড়াই, ভৈরব, কুমার, আড়িয়াল খাঁ’ পদ্মার প্রাচীন খাত সমূহ। বতৃমানে এগুলা পদ্মার শাখা নদী হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে।
ঘড়িয়ালটি ২০১৫ সালে চারঘাটের পদ্মায় ধরা পড়ে |
পদ্মায় আগে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালী ইলিশ পাওয়া যেত। প্রায় দশ বছর পর গত বছর থেকে চারঘাটে সীমিত আকারে ইলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। এসব ইলিশ স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হয়। পদ্মায় পানি কমে আসায় আগের মত আর ইলিশের দেখা পাওয়া যায় না। সম্প্রতি চারঘাটের বিভিন্ন স্থানে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মার নাব্যতা সঙ্কট এর অন্যতম কারণ। এক সময় পদ্মায় দেখা মিলত কুমি সদৃশ ঘরিযালের। খ্যাদের অভাব, ব্যাপক হারে শিকার, নাব্যতা কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ঘরিযালের সংখ্যা এখন অতি নগণ্য পর্যাযে পৌছেছে। স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যেই ঘরিয়াল রক্ষায় জনসচেতনতা সহ আরো বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। পদ্মার ঘরিয়াল সব স্থানে পাওয়া যায় না।
শুশুকটি ২০১৫ সালে পদ্মা থেকে মাছ ধরার জালে ধরা পড়ে |
ঘরিয়ালের মত শুশুকও পদ্মার বুক থেকে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। শুশুক এক প্রকার ডলফিন।পদ্মার শুশুক পৃতিবীতে খুব বেশি পাওয়া যায় না। এটির নাম গাঙ্গেয় শুশুক। পৃথিবীর বিরলতম প্রাণী এটি। এখনো মাঝ পদ্মায় উঁকি দেয় স্তন্যপায়ী প্রাণীটি। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পানির ওপর আসতে হয় শুশুককে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় এদের চলাচলের পথ কমে গেছে। আর তাই হ্রাস পেয়েছে এদের প্রজনন ক্ষমতা। খাবার সঙ্কট, নদীতে কারেন্ট জাল ব্যবহার ইত্যাদি কারণে শুশুকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও পদ্মায় এখন অনেকে অবৈধভাবে মাছ শিকারের জন্য বাঁশের ফাঁদ পেতে রাখছে। আর এই ফাঁদের কারণে শুশুক আর আগের মত চলাচল করতে পারছে না। অনেক সময় মারাও পরছে প্রাণীটি। পদ্মার আরেকটি বিপন্ন প্রণী হর কাছিম। এক যুগ আগেও পদ্মার চরে, বিশেষ করে ইউসুপপুর, মুক্তারপুরের চরে কাছিমের ডিম পাওয়া যেত। কিন্তু এখন যায় না বললেই চলে। কাছিমের শিকারের কারণে দিন দিন নিঃশেষ হচ্ছে এই অঞ্চলের কচ্ছপ গুলি।
চারঘাটে পদ্মার পাড়ে বেশ কয়েকটি বালু মহাল আছে। বর্তমানে মুক্তারপুর ও থানাপাড়া মৌজাতে দু'টি বালু মহাল আছে। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়াও রাওথা ও থানাপাড়া গ্রামে আরো দু'টি বালু মহাল আছে। পদ্মা এভাবেই চারঘাটের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে।
শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে নৌকা নোঙ্গর করে রাখা হয়েছে।
শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি কমে যাওয়ার পর জেলেরা এভাবেই নদীতে নৌকা নোঙ্গর করে রাখে স্থানঃ থানাপাড়া, সারদা |
বর্ষা কালে যৌবন ফিরে পেয়েছে পদ্মা নদী নিরিবিলি, সারদা |
নিচের ছবিতে জানুয়ারী মাসে শান্ত পদ্মা
ধীরে বয়ে চলছে পদ্মা থানাপাড়া, সারদা |
চারঘাটে পদ্মার বেশ কযেকটি চর জেগে উঠেছে। এগুলা স্থানীয়দের কাছে গঙ্গা চর নামে পরিচিত। ইউসুফপুর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে একটি বড় চর বড়ালের মুখ বরাবর চলে এসেছে। রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার চরে এখন নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাস। এখানে আশ্রয় নিয়েছে বিরল প্রজাতির অনেক পাখি। চরে নানা প্রজাতির গাছের সমারহ দেখা যায়। কয়েকটি চরে লোকালয় গড়ে উঠলেও বেশির ভাগ চর এখনো জনমানবহীন। এসব চরে রাখাল গরু, ছাগল ও মহিষের পাল নিয়ে নৌকাতে করে আসে। সবুজ ঘাসে তৃপ্ত হওয়ার পর রাখাল তার পোষ্য নিয়ে আবার আপন আলয়ে ফিরে যায়।
তবে পদ্মার চর রাজশাহী অঞ্চলে বেশ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পদ্মা এখন খানিকটা পশ্চিম দিকে সরে গেছে। আর শহরের পাশে বড় বড় চর জেগে উঠেছে। ফলে রাজশাহীর পাশের প্রমত্তা নদী ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। এখন জেলেরা এই অংশে বেশি মাছ পাচ্ছে না। চর জাগায় নদীর মূল অংশ পশ্চিমে সরে গেছে। ফলে পদ্মা যৌথ নদীতে পরিণত হচ্ছে। বেশ কিছু চর ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে। সেসব অংশের পদ্মা এখন যৌথ নদী। বাংলাদেশের জেলেরা এখন আর ভারতের অংশে যেয়ে মাছ ধরতে পারছে না। আবার পদ্মা পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ায় রাজশাহীর আরো বেশ কিছু চর বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এসব চর বিলীন হলে পদ্মা যৌথ নদীতে পরিণত হবে আর ক্ষতিগ্রস্থ হবে রাজশাহী অঞ্চলের অগনিত মানুষ। পদ্মা গার্ডেনের কাছে পদ্মা একটি ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। পদ্মা গার্ডেনের কিছু দক্ষিণে আছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের এক নাম্বার ড্রেন সহ আরো বেশ কিছু ড্রেন। ড্রেনটি পূর্বে পদ্মার শাখা নদী বারাহী বলে পরিচিত ছিল। প্রতিনিয়ত সেসব ড্রেন থেকে পানি আসছে বলে সামান্য পানি আছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানি নাই আবার বর্ষাকালে ফারাক্কার গেট খুললে বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে পুরো জনপদ। চারঘাটে পদ্মা মেতেছে এক ভয়ংকর উম্মাদনায়। বিশাল চর পড়ায় পদ্মার বাম অংশ বইছে ক্ষীণধারায়। নলকূপে পানি উঠছে না, মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। চরের ওপাশে নদীর মূল ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। আবার বর্ষাকাল এলেই তীব্র গতিতে পদ্মা বিনাশ করছে লোকালয়। ইউসুফপুর, টাঙ্গনের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল পদ্মার গর্ভে বিলীন হচ্ছে। রাস্তাঘাট, বাড়ি-ঘর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিছুই বাদ যাচ্ছে না। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন নিরিবিলি এলাকায় ব্লক ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। চরম হুমকির মুখে আছে পদ্মার বামতীর রক্ষা বাধঁ। তবে চারঘাটের নতুন সমস্যার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে বড়াল। পদ্মাতে সারা বৎছর সামান্য পানি থাকলেও বড়ালে সেই পানি যাচ্ছে না। বছরে মাত্র চার মাস পদ্মা থেকে বড়ালে পানি আসে। বড়ালের উৎস মুখের কাছে চর পড়ায় এখন আর পদ্মার বিপুল জলরাশি বড়ালে প্রবেশ করছে না। রেনেলের ম্যাপে (১৭৬৫-১৭৭৬) গঙ্গা চর ছিল নারদ আর বড়ালের মধ্যবর্তী অংশে। এখন সেই চর আকারে অনেক গুন বেড়েছে। ফারাক্কা বাধঁ নির্মাণের পরেও, স্লইচ গেট নির্মাণের আগেও যেখানে বড়ালে প্রায় ২১০০০ কিউসেক পানি আসত এখন আসে মাত্র তিন হাজার। কিন্তু সেই পানিও আসে মাত্র বছরে মাত্র চার মাস। বড়ালের উৎস মুখের কাছে পদ্মার পানি কমে যাওয়ার কারণে এই সমস্যা। বড়ালে পানি বৃদ্ধির জন্য বড়ালের মুখ কয়েকবার খনন করা হয়েছে। অথচ পদ্মার নির্দিষ্ট অংশে ডেজিং করা না হলে বড়ালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।
স্যাটেলাইট ইমেজে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সামনের পদ্মা |
আরো দেখুন: চারঘাটের বড়াল নদ
চারঘাটের মহানন্দা নদ
ছবিতে পদ্মার বুকে সন্ধা নামছে।
পদ্মায় সন্ধ্যা নামছে থানাপাড়া,সারদা |
পদ্মাতে সন্ধ্যার অপরূপ দৃশ্য নিরিবিলি, সারদা |
পদ্মার গতিপথঃ
পদ্মার গতিপথ সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। টলেমি গঙ্গা নদীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় প্রাচীন গঙ্গা নদী প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান গোয়ালন্দ থেকে অনেক উত্তরে ঢাকা ভাওয়ালের পাশে ‘এ্যান্টিবোল’ হয়ে প্রবাহিত হতো। তখন ঐ অঞ্চলকে ‘এ্যান্টিবোল সাগর’ বলে পরিচিতি রয়েছে (জেমস টেলর)। প্রাচীন কালের শেষ দিকে ও মধ্য যুগের প্রথম দিকে পদ্মা ছোট নদীতে পরিণত হয়। তখন গঙ্গার মূল ধারা ভাগীরথী, গড়াই প্রভৃতি দিয়ে প্রবাহিত। মধ্যযুগের সূচনার পরে পদ্মাকে চট্ট্রগ্রামের নিকট ব্রহ্মপুত্রের সাথে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতে দেখা গেছে। ফরিদপুরের ইদিলপুরে মধ্যযুগের নিদর্শনে পদ্মাবতীর নামের সন্ধান পাওয়া যায়। মূলতঃ ৩০০/৪০০ বৎসর পূর্বে পদ্মার ধারা বর্তমান ধারা থেকে আরো উত্তরে বোয়ালিয়া (রাজশাহী শহর) পাবনার চলনবিল, ইছামতি (মানিকগঞ্জ) ধলেশ্বরী একাকারে ঢাকার দক্ষিণ দিয়ে শ্রীপুরের কীর্তিনাশা হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হত। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্যকারী, ইতিহাসের খলনায়ক রাজা রায় বল্লভের প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরের মন্দির ও প্রাসাদ ধবংস করে পদ্মা কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে। এখন পদ্মা ভগবানগোলা থেকে প্রায় ১০ কিঃমিঃ উত্তরে সরে এসে রাজশাহী শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত।
পদ্মার গতিপথ নবীন না প্রাচীন?
পদ্মার গতিপথ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়ে আসছে। অনেকেই, বিশেষত ভারতের নদী গবেষকগণ মত দিয়ে থাকেন যে ভাগীরথী খাতটি পদ্মার চেয়ে প্রাচীন। পূর্বে গঙ্গার মূল ধারা ভাগীরথী দিয়ে প্রবাহিত হত। আর পদ্মার সৃষ্টি হয়েছে মাত্র কয়েকশত বছর পূর্বে। এর আগে গঙ্গার পানি পদ্মায় যেত না অথবা পদ্মা নামের কোন নদীই ছিল না। এবার কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
এক.
ইতিহাসগ্রন্থে ধরে নেয়া হয়েছে যে, পদ্মা নামের গঙ্গার শাখাটি নতুন। এর আদিশাখা ভাগীরথী। যেমন: ‘একসময়ে গঙ্গার জলস্রোত একমাত্র ভাগীরথী দিয়েই প্রবাহিত হত; পরে এই জলরাশি পদ্মা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ভাগীরথী ক্ষুদ্রকায়া নদীতে পরিণত হল। … পবিত্র গঙ্গানদীর বেশীর ভাগ জল এখন পদ্মাগর্ভ বহন করছে; তাই পদ্মা এখন একটি মহানদী। তবু কিন্তু গঙ্গাজলের পবিত্রতা এই ভাগীরথী বা হুগলী নদীর জলে বর্তমান; পদ্মার জলে তা নেই। দূর দূর থেকে পুণ্যার্থীরা এই ক্ষুদ্র নদীগর্ভেই স্নান করতে আসে।’ (ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত)
দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁর পালপূর্ব যুগের বংশানুচরিত নামের গ্রন্থটিতে প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস আলোচনায় সঙ্গত কারণেই পদ্মার প্রবাহ পরিবর্তনের উল্লেখ অনেকবার করতে বাধ্য হয়েছেন, আধুনিক কালের পদ্মার প্রবাহ বিষয়ে তার একটি উল্লেখ থেকে পাঠকেরা পদ্মার প্রাচীন ও হাল আমলের নড়াচড়া সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন: ‘ফরিদপুর জেলার ইদিলপুরে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীর চন্দ্রবংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্রের শাসনে পদ্মা (পদ্মাবতী?) নদীর সর্বপ্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন এ অঞ্চলে পদ্মানামের যে ক্ষুদ্র নদী প্রবাহিতা ছিল, পরে গঙ্গার পূর্বশাখার জলস্রোত তার খাতে পড়ার ফলে সেটি ক্রমে সুবৃহৎ নদীতে পরিণত হয়ে পদ্মা নাম পায় বলে মনে হয়… বিগত কয়েক শতাব্দীতে পদ্মা নদীর বহু বিবর্তন ঘটেছে। পন্ডিতেরা মনে করেন পদ্মা এক সময় রামপুর বোয়ালিয়ার কাছ দিয়ে চলন বিলের পথে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার খাতে ঢাকা পেরিয়ে মেঘনার নিম্নভাগে পড়ত; কিন্তু অষ্টাদশ শতকে নদীটি ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে এসে দক্ষিণ শাহাবাজপুর দ্বীপের উপর দিকে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুরের প্রায় বিশ মাইল দক্ষিণে মেঘনার মোহনায় মিলিত হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবগণের সভাসদ রাজা রাজবল্লভের নির্মিত রাজনগর এক সময় পদ্মার বামতীরে অবস্থিত ছিল এবং নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদী পদ্মা ও মেঘনাকে সংয্ক্তু করত। রাজনগর প্রভৃতি বহুজনের কীর্তি পদ্মাগর্ভে বিলীন হওয়ায় এখানে নদীর নাম হয় কীর্তিনাশা।’
দীনেশচন্দ্র সরকার গঙ্গার শাখা হিসেবে পদ্মার উদ্ভব ঘটার সম্ভাব্য কালও একটা নির্ধারণ করেছেন ‘ষোড়শ শতকের পূর্বে গঙ্গানদী গৌড়-নগরের উত্তর ও পূর্ব দিয়ে প্রবাহিত হত এবং সে সময়ে ঐখান থেকেই গঙ্গার পূর্ব-দক্ষিণ বাহিনী পদ্মা শাখার উদ্ভব হয়। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দী থেকে গঙ্গার ভাগীরথী ও পদ্মারূপে দ্বিখণ্ডিতভাব গৌড়নগরের অনেকটা দক্ষিণদিকে ঘটেছে।
বাঙালির আরেক ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ও ভাগীরথীকেই গঙ্গার আদি শাখা বলে মনে করেন, তার বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব গ্রন্থে তিনি এমনকি উইলকক্স-এর ভাগীরথী নদীটি ভগীরথ কর্তৃক খনিত হবার সম্ভাবনাটিকেও অনৈতিহাসিক বলে মন্তব্য করেছে। তবে তার সাক্ষ্য ইতিহাস নয়, পুরাণ গ্রন্থই: ‘রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহই যে যথার্থত ভাগীরথী ইহাই রামায়ন-মহাভারত-পুরাণের ইঙ্গিত, এবং এই প্রবাহের সঙ্গেই সুদূর অতীতের সূর্যবংশীয় ভগীরথ রাজার স্মৃতি বিজড়িত।’
দুই.
‘আমরা দেখেছি আদি-মধ্যযুগে গঙ্গার পূর্বশাখা অর্থাৎ পদ্মানদীর উদ্ভব হয়নি। এমনকি মধ্যযুগেও কোন সময় করতোয়া ও ব্রহ্মপুত্র একযোগে সমুদ্রে পড়ত বলে বোধ হয়। তাই দেখতে পাই প্রাচীন যুগে কামরূপের রাজগণ সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া নৌকায় চাপিয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তেন এবং গঙ্গা বেয়ে বিহারের দিকে চলে যেতেন। ভাস্করবর্মা ২০,০০০ হাজার হস্তী ৩০,০০০ নৌকায় চড়িয়ে ঐরূপে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।’
আমরা এখানে দুটি থেকে যুক্তি লক্ষ্য করছি যার ওপর ভিত্তি করে অনেক নদী গবেষক পদ্মার ধারাটিকে নবীন বলে থাকেন। আবার অনেকেই পদ্মার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও সেটা গঙ্গা বিচ্ছিন্ন একটি ছোট শাখা নদী হিসেবে বর্ণনা করছেন।
তবে নীহাররঞ্জন পদ্মার যে বয়স নির্ধারণ করেছেন, তা পরবর্তীকালের ইউরোপীয় পর্যটকদের চেয়ে অধিক বয়েসী। এই বিষয়ে একই মত কপিল ভট্টাচার্যেরও, নানান ঐতিহাসিক তথ্য থেকে তাদের অনুমান পদ্মা এমনকি আরও উপরের পথ দিয়ে চলন বিল, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী ইত্যাদিকেও জড়িয়ে প্রবাহিত হয়েছে আরেকটি কালে; বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী তখন পদ্মারই প্রবাহ ছিল, বর্তমানে তা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের খাতে প্রবাহিত।
তাহলে পদ্মার সৃষ্টি কথন হল? আর সেই পদ্মা কি নিছক একটা শাখা নদী নাকি গঙ্গার শাখা?
এক. ষোড়শ শতকের আগে পদ্মার সাথে গঙ্গার সম্পর্কহীনতা বিষয়ক দীনেশ, ইটন প্রভৃতির ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিলের কল্যাণে। পঞ্চদশ শতকের কবি কৃত্তিবাস ওঝা, নদীয়ার বাসিন্দা ছিলেন তিনি, বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী তার জীবনকাল ১৩৮১-১৪৬১। তিনি ‘রামায়নে’ পদ্মার কথা উল্লেখ করেছেন।
আগে যায় ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া/ কাণ্ডারের প্রতি গঙ্গা মুক্তিপদ দিয়া।
গৌড়ের নিকটে মিলিল আসিয়া।।/পদ্মা নামে এক মুনি পূর্ব্বমুখে যায়।
ভগীরথ বলি গঙ্গা পশ্চাতে গোড়ায়।।/যোড়হাত করিয়া বলিলেন ভগীরথ-
পূর্ব্বদিকে যাইতে আমার নাহি পথ।।/পদ্মমুনি লয়ে গেল নাম পদ্মাবতী।
ভগীরথ সঙ্গেতে চলিল ভাগীরথী।।/শাপবাণী সুরধুনী দিলেন পদ্মারে।
মুক্তিপদ যেন নাহি হয় তব নীরে।।
এই কাহিনীতে আসল প্রবাহ হবার কথা ছিল ভাগীরথীরই, কিন্তু পথে পদ্মামুনি পূর্বদিকে ভুলিয়ে নিয়ে এলেন নদীটিকে। সুরধুনী (গঙ্গার একটি শাখা, আবার গঙ্গার একটি নামও বটে, এখানে দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত) পদ্মাকে অভিশাপ বাণী দিলেন, যেন তার নীড়ে মুক্তিপদ নাহি হয়।
কৃত্তিবাসী এই উল্লেখ কিন্তু দুটো প্রশ্ন ফয়সালা করে, প্রথমত ইটন প্রমুখদের কথিত সময়ের আগেই গঙ্গার সাথে পদ্মার একটা সম্পর্কের একটা স্বীকৃতি এখানে পাওয়া যাচ্ছে, বাতিল হচ্ছে দীনেশচন্দ্র সরকারের যাবতীয় অনুমান। তাদের অনুমান অনুযায়ী এই মিলনটি আরও বহু পরে ঘটেছিল। শুধু যে পদ্মাকে গঙ্গার সাথে যুক্ত দেখেছেন কৃত্তিবাস, তাই নয় ,এগার নিবরে যখন বারতে প্রবেশ/ হেন বেলা পড়িতে গেলাম উত্তরের দেশ।।/ বৃহস্পতিবারের বেলা ঊষা পোহালে শুক্রবার/ বারেন্দ্র উত্তরে গেলাম বড় গঙ্গাপার । এখানে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি বরেন্দ্রভূমি পৌঁছাতে বড় গঙ্গা পাড়ি দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, ভৌগোলিক বিচারে এই বড় গঙ্গা পদ্মা, তার রচনায় পুন্যতীর্থ ভাগীরথীরকেই ছোটগঙ্গা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে পরিস্কার যে, কৃত্তিবাসের কালেই পদ্মা গঙ্গার অধিকাংশ জল নিষ্কাষণ করছিল।
সিয়ার-আল-মুতাক্কিরিন এ লিপিবদ্ধ হয় যে, করতোয়া গঙ্গার তিনগুণ ছিল যখন বখতিয়ার খিলজি ১১১৫ সালে বাংলার উত্তরাঞ্চল দখল করেন।এখানে একটি বিষয় খুব ভাল করে বুঝতে হবে। গঙ্গা প্রাচীন কালে করতোয়ার চেয়ে অনেক বড় নদী ছিল; এখনো বটে। করতোয়া আগে বিশাল বিপুলা ছিল বটে, তবে সেটা গঙ্গার ন্যায় না। তাহলে বইয়ে উল্লেখ করা নদীটি সম্ভবত পদ্মা, যার দৈর্ঘ্য পূর্বে করতোয়ার চেয়ে অনেক কম ছিল।
এবার আমরা আরো প্রাচীন নিদর্শনের দিকে তাকাব। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের বাঙালী লেখক ভুসুকু পা প্রথম ‘পদ্মা খালে’র কথা উল্লেখ করেছিলেন। ‘বাজলার পাঁড়ী, পঁ-উ-আ খালে বাঁহিউ’ অর্থাৎ পদ্মাখালে বজরা নৌকা পাড়ি দিতেছে। ভুসুকু পা’র আসল নাম ছিল শান্তিদেব। তিনি ধর্মপালের সময় বর্তমান ছিলেন। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে শান্তিদেব ভুসুক সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে ভুসুকুর জীবিৎকালের শেষ সীমা ৮০০ খ্রিস্টাব্দ। এই প্রথম কোন বাঙালী লেখকের বিবরণে পদ্মার নাম পাওয়া গেল। এর থেকে বোঝা যায় যে পদ্মার অস্তিত্ব সপ্তম শতকেও ছিল তবে সেটি আকারে ছোট ছিল।
প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে বিশ্বখ্যাত ভূগোলবিদ টলেমি যে মানচিত্র একেছিলেন সেখানে গঙ্গার সমুদ্রগামী পাঁচটি খাতের কথা উল্লেখ আছে। জেমস টেলরের বর্ণনায় পদ্মা ঢাকার শ্রীপুরের মফলৎগঞ্জ ও রাজনগরের কিছুটা উত্তর দিয়ে প্রবাহিত। এটাই গঙ্গার প্রধান শাখা যা প্রশস্ততা ছিল ২/৪ মাইল।
যারা ভাগীরথীকে গঙ্গার মূল প্রবাহ প্রমাণে ব্যস্ত তারা মূলত মহাভারতের কিছু উদাহরণের আশ্রয় নেয়। মধ্যপুরাণ ও মহাভারতে গঙ্গার পূর্বগামী ৩টি ধারা হলদিনী, পাবনী ও নলিনীর, উল্লেখ রয়েছে। অনেকের ধারণা পাবনী থেকে পদ্মার নাম এসেছে যা পাবনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার পদ্মার প্রাচীন নাম হল ‘নলিনি’। পদ্মর আরেক নাম নলিন। পদ্ম-নলিন, পদ্মা-নলিনি, এভাবেও হিসাব করা যেতে পারে। অর্থাৎ পদ্মার গতিপথ নবীন নয় বরং অনেক পুরাতন। জন্ম অবধি এটি গঙ্গার জল বয়ে নিয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরে।
দুই. প্রাচীন যুগে কামরূপের রাজাগণ সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া নৌকায় চাপিয়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়া এবং গঙ্গা বেয়ে বিহারের দিকে চলে যাওয়ার ঘটনা পদ্মার অনুপস্থিতি কিংবা গঙ্গা বিচ্ছিন্নতার কারণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট না। সে সময় বঙ্গের এই অংশে অনার্য রাজাদের আবাস ছিল। আর তাই আর্যগন এই পথ পরিহার করতেন। যদিও সেসময় ভাস্করবার্মা আর হর্ষবর্ধনের প্রধান শত্রু শশাঙ্কের সাম্রাজ্যের পতন হয়। আবার হতে পারে পদ্মা সেই সময় খুব বড় কোন নদী ছিল না। ভুসুকুপার বর্ণনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এবার সাহিত্য বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক বিচারে ঘটনাটিকে দেখা যাক। নীহাররঞ্জন কামরূপরে রাজাদের ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পাড়ি দেওয়ার উদাহরন নিছক গল্প ছাড়া কিছু্ই না। মহাভারতে ব্রহ্মপুত্রের নাম লৌহিত্য। বর্তমান সময়ের আসামের কিছু অংশ, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ নিয়ে তখন কামরূপ গঠিত হয়েছিল। পুরো সিলেট আর ময়মনসিংহের একটা বড় অংশ প্রাচীন কালে একটি সাগরের নিচে ছিল। এই সাগরের নাম কেউ বলে ‘কালিদহ সাগর’; কেউ বলে ‘লৌহিত্য সাগর’ আর টলেমি বলছে এ্যান্টাবোল সাগর। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গবেষকদের মতে এই সাগরের নাম কালিদহ সাগর আর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গবেষকদের মতে এই সাগরের নাম লৌহিত্য সাগর। জনবসতি শুরু হওয়ার পর থেকে এই হাওরাঞ্চল দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক ভাগ ময়মনসিংহ অঞ্চল প্রাচীন কালে কোচদের স্বাধীন রাজ্য ছিল অপর দিকে বৃহত্তর সিলেটের হাওরাঞ্চল খাসিয়াদের দখলে ছিল।এই দুই অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচার, ভাষা ইত্যাদি বর্তমানেও দুইরকম। হয়তবা এ কারণেই দুই অঞ্চলে এই সাগর দুই নামে পরিচিত হয়েছে। কালিদহ কিংবা লৌহিত্য যাইহোক না কেন এই অঞ্চল সমূহ এক সময় সাগর গর্ভে নিমজ্জিত ছিল সে বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত হওয়াটাই স্বাভাবিক, কারন হাওরাঞ্চলের বর্তমান অবস্থা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এই অঞ্চল এক সময় বিশাল সাগরে নিমজ্জিত ছিল। হট্টাথের পাঁচালী হতে অনুমান করা হয় শ্রীহট্টের বিস্তৃত সমতল ও নিম্ন ভূমি সকল অর্থাৎ শ্রীহট্টের দক্ষিনাংশ, দক্ষিণ শ্রীহট্টের পশ্চিমাংশ, করিমগঞ্জ হাকালুকি প্রভৃতি অংশ বিশেষ হবিগঞ্জের উত্তরাংশ এবং প্রায় সমূদয় সুনামগঞ্জ তৎকালে অনেকটা জলতলে ছিল। সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে চুনা পাথর ও একধরনের ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবালদ্বারা সৃষ্ট। এগুলো থেকে সাগরের বিস্তৃতি বিষয়ে ধারনা করা হয়। ঐতিহাসিক হান্টার সাহেব এবং ঐতিহাসিক ভ্রমনকারী হামিলটন সাহেবের বর্ণনা হতেও এ বিষয়টি জানা যায়। ৬৪০ সালে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন্থ সাং ষ্টীমার যোগে এই অঞ্চল সমূহের উপর দিয়েই কামরুপের রাজা কুমার ভাষ্কর বর্ম্মার আমন্ত্রণে কামরূপ আগমন করেছিলেন।
তাহলে কামরূপের রাজাগণ ব্রহ্মপুত্র যোগে যে সমুদ্রে নামতেন সেটা বঙ্গোপসাগর নয় বরং সেটা ছিল ‘লোহিত্য সাগর’; যেখানে লোহিত্য এসে পড়ত। অবশ্য এই কালিদহ, লোহিত্য কিংবা এ্যান্টাবোল সাগর বঙ্গোপসাগরের উত্তর অংশ ছিল । গঙ্গা নদীর মোহনা লোহিত্য সাগর আর বঙ্গোপসাগরকে পৃথক করেছিল কারণ টলেমির মানচিত্রে গঙ্গা এ্যান্টাবোল দিয়ে প্রবাহিত। অর্থাৎ গঙ্গার আদি ধারার সাথে ব্রহ্মপুত্রের কোন মিল ছিল না এবং দুটি নদীর মোহনাই ছিল আমাদের আলোচ্য লোহিত্য সাগর। এখানে পদ্মা হীনতার কোন প্রমাণ মিলছে না বরং গঙ্গার প্রধান ধারা বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রবাহের প্রমাণ শিলছে। তাই সমুদ্র থেকে পুনরায় গঙ্গা যাত্রা, গঙ্গার পদ্মা খাতে প্রবাহের যথার্থ প্রমাণ বহন করে। তবে সেটা হয়তবা গঙ্গা নামেই। খাত পরিবর্তন করে পদ্মা বর্তমান খাতে এসে প্রবাহিত হচ্ছে।
সত্যি বলতে পদ্মা নামের/খাতের প্রাচীনতা নিয়ে গবেষণা করা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের আলোচনার মূল বিষয় হওয়া উচিত ‘গঙ্গা কি প্রচীন কালে ভাগীরথী দিয়ে কলকাতার পাশ দিয়ে সমুদ্র যাত্রা করত নাকি বর্তমান বাংলাদেশ অংশে গঙ্গার মূল ধারা প্রবাহিত হত’। আমরা দেখেছি প্রাচীন কাল থেকেই গঙ্গা সমুদ্র যাত্রার জন্য বাংলাদেশ অংশে নিজের বেশির ভাগ জল উজার করে দিয়েছে। এবার আমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ গঙ্গার আদি খাত নিয়ে আলোচনা করব।
গঙ্গার আদি খাত কোনটি? ভাগীরথী নাকি পদ্মা?
প্রথমে গঙ্গার কয়েকটি প্রচীন খাতের বিবরণ দেখব আমরা।
১*রেনেল ও ফ্যানডেন ব্রকের নকশায় দেখা যায় ষোড়শ শতকে পদ্মা বেগবতী নদী। সিহাবুদ্দিন তালিশ (১৬৬৬), মির্যা নাথনের (১৬৬৪) বিবরণীতে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমে ইছামতির উল্লেখ করেছে। ইছামতির তীরে যাত্রাপুর এবং তিন মাইল উত্তর পশ্চিমে ডাকচড়া (মানিকগঞ্জ) এবং ঢাকার দক্ষিণে গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের সম্মিলন প্রবাহের সমুদ্র যাত্রা। ড. নীহাররঞ্জন বলেন, ‘তখন গঙ্গার এ প্রবাহে পদ্মার নামকরণ দেখছি না। ‘আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আবুল ফজল লিখেছেন (১৫৯৬-৯৭), ‘কাজীর হাটের কাছে পদ্মা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে একটি শাখা পূর্বগামিনী পদ্মাবতী নাম নিয়ে চট্রগ্রামের নিকট সমুদ্রে মিশেছে।’ মির্যা নাথানের বর্ণনায় করতোয়া বালিয়ার কাছে একটি বড় নদীতে পড়েছে। এই বড় নদীটির নাম পদ্মাবতী।
২*চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা (১৩৪৫-৪৬) চীন দেশে যাওয়ার পথে চট্রগ্রাম নেমেছিলেন। তিনি চট্রগ্রামের হিন্দু তীর্থস্থান গঙ্গা নদী ও যমুনা নদীর সঙ্গমস্থল বলেছেন। তাতে বোঝা যায় চতুর্দশ শতকে গঙ্গার মধ্যবর্তী প্রবাহ পদ্মা চট্রগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তটভূমি প্রসারের সাথে সাথে চট্রগ্রাম এখন অনেক পূর্ব দক্ষিণে সরে গিয়েছে। ঢাকাও এখন পদ্মার উপর অবস্থিত নয়। পদ্মা এখন অনেক দক্ষিণে নেমে এসেছে। ঢাকা একন পুরাতন গঙ্গা পদ্মার খাত বুড়িগঙ্গার উপর অবস্থিত আর পদ্মা ব্রহ্মপুত্রের (যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দের অদূরে। পদ্মা তার খাত বারবার পরিবর্তন করেছে তার যথেষ্ট প্রমাণাদি এ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। দশম শতকের শেষে এবং একাদশ শতকের গোড়ায় চন্দ্রবংশীয় রাজারা বিক্রমপুর, হরিকেল অর্থাৎ পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেকটা জুড়ে রাজত্ব করতেন। এই বংশের মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র তার ইদিলপুর পট্রলীদ্বারা স্মতট পদ্মাবতী অঞ্চলের অন্তর্গত কুমার তালক মন্ডলের জনৈক ব্রাহ্মণকে একখন্ড ভূমি দান করেছিলেন। পট্রলীও সমসাময়িক সাহিত্য গ্রন্থেও পদ্মা নদীর উল্লেখ আছে।
৩* ব্রহ্মপুত্র বর্তমান যমুনার খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করার আগে পদ্মা ধলেশ্বরী বুড়িগঙ্গার খাতে প্রবাহিত হত। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিস্তা অকস্মাৎ তার পূর্ব যাত্রা পরিত্যাগ করে এবং তার বিপুল বন্যার বারিরাশি ব্রহ্মপুত্রের বন্যার পানির সঙ্গে মিশে যমুনার খাতে বইতে শুরু করে দেয় গোয়ালন্দের পাড়ে। প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরের মন্দির প্রাসাদ ধবংস করে পদ্মা কীর্তিনাশা নাম ধারণ করে। জেমস টেলরের বর্ণনায় কীর্তিনাশা ঢাকার শ্রীপুরের মফলৎগঞ্জ ও রাজনগরের কিছুটা উত্তর দিয়ে প্রবাহিত। এটাই গঙ্গার প্রধান শাখা যা প্রশস্ততা ছিল ২/৪ মাইল। রেনেলের মানচিত্রে টেলরের বর্ণনায় কীর্তিনাশা কার্তিকপুরের উত্তরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। গঙ্গার দ্বিতীয় শাখা টেলরের বর্ণনায় নয়াভাঙ্গনী নদী (আড়িয়াল খাঁ) ঢাকা জেলার কোল বেয়ে বাকেরগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। মূলতঃ ৩০০/৪০০ বৎসর পূর্বে পদ্মার ধারা বর্তমান ধারা থেকে আরো উত্তরে বোয়ালিয়া (রাজশাহী শহর) পাবনার চলনবিল, ইছামতি (মানিকগঞ্জ) ধলেশ্বরী একাকারে ঢাকার দক্ষিণ দিয়ে শ্রীপুরের কীর্তিনাশা হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রবাহিত হত। ২০০ থেকে ২৫০ বছরের মধ্যে পদ্মা অনেক দক্ষিণে সরে এসে বর্তমান খাতে রাজবাড়ি জেলার কোল ঘেঁষে জেলার উত্তর সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
এবার আমরা দেখব গঙ্গার আদি খাত পদ্মা নাকি ভাগীরথী। খ্যাতিমান ভারতীয় নদীপ্রকৌশলী কপিল ভট্টাচার্য ও সেচপ্রকৌশলী উইলিয়াম উইলকক্স মনে করেন, গঙ্গার আদি খাত পদ্মাই। ভাগিরথী তাঁদের মতে গঙ্গা-পদ্মা থেকে কেটে আনা খাল ছাড়া আর কিছুই না। কপিল ভট্টাচার্য থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক: ‘বাংলাদেশের মানুষের মনের সংস্কার কিন্তু ভাগীরথীকেই গঙ্গার প্রধান প্রবাহ খাত বলে মনে করে। হিন্দু সভ্যতায় গঙ্গা মাহাত্ম্যের প্রচারণা এই ভাগীরথীকেই গঙ্গা বলে প্রচার করেছে। উইলকক্স সাহেবের পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক ও ইঞ্জিনিয়ারেরাও ১৯২৮ খৃস্টাব্দের পর বলতে চেয়েছেন, ভাগীরথীই গঙ্গার প্রথম মুখ্য খাত… কিন্ত ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা ভাগীরথীর গঙ্গার প্রধান খাত হওয়া সম্বন্ধে সন্দেহ আনে। তারা বলেন, ভাগীরথী-হুগলীর নিম্নাংশ প্রথম থেকেই সমুদ্রের খাঁড়ি ছিল। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে ও বিহারের গাঙ্গেয় উপত্যকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক গাঙ্গেয় পলিস্তরের নিচে যে হরিদ্রাভ লাল কংকর প্রস্তর মিশ্রিত মৃত্তিকার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, হিমালয় পর্বত থেকে আজকের এই বিপুলায়তন গঙ্গা সম্পূর্ণ অবতরণ করবার আগে এখানকার সাগরগর্ভ মধ্যপ্রদেশ ও ছোটনাগপুরের পার্বত্য উপত্যকায় উৎপন্ন প্রাচীন বিশালায়তন নদীর জলধারায় বাহিত পলির দ্বারাই পূর্ণ হয়েছিল। দামোদর প্রভৃতি প্রাচীন সংস্করণ নদ-নদীর পলি দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভাগীরথী উপত্যকার নিম্নতম স্তর গঠিত। সুতরাং গঙ্গা অবতীর্ণ হয়ে প্রথমেই বর্তমান পদ্মার প্রবাহপথে প্রবাহিত হত, অথবা ভাগীরথীর পথে প্রবাহিত হত, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে গেলে সমস্ত গঙ্গা-পদ্মা ও ভাগীরথীর খাতে গভীর নল পুতে ওই হরিদ্রাভ লাল মাটির ঢাল (slope) পরীক্ষা করতে হবে।’
‘পদ্মাকে গঙ্গার প্রধান খাত হিসেবে মেনে
নিতে বৈজ্ঞানিক কোন অসুবিধাই হয় না’ এই মতে দৃঢ় থেকে কপিল ভট্টাচার্য
ভৌগোলিক ঢালের গঠনগত কারণও স্পষ্ট করেন: ‘বাংলা দেশের গঙ্গার ব-দ্বীপের
উচ্চাবচকতা নিদর্শক মানচিত্র (রিলিফ ম্যাপ) দেখলে বোঝা যায়, গঙ্গা থেকে
ভাগীরথীর উৎপত্তি স্থানটিই সর্বোচ্চ, এবং ভাগীরথী অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি
দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে, এর পূর্বদিকস্থ নিম্নাঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়নি।
ভগবানগোলা থেকে সুন্দরবনের বিদ্যাধরী নদীর মোহনা পর্যন্ত যদি একটি সরল রেখা
টানা যায়, তা হলে এই সরল রেখার পশ্চিমের ভূভাগ ক্রমশঃ পশ্চিম দিকে উঁচু
হয়ে ছোটনাগপুরের মালভূমিতে মিশেছে। আর ওই সরল রেখা থেকে পূর্বে ভূভাগ
ক্রমশঃ ঢালু হয়ে গিয়েছে মধ্যবঙ্গে। ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা প্রভৃতি জেলা
নিম্নতম ভূমিতে অধিষ্ঠিত, তারপর ভূমি আবার পদ্মা-মেঘনার পূর্বপারে ক্রমশঃ
উচু হয়ে ত্রিপুরা-চট্টগ্রামের পর্বতে উঠেছে। গঙ্গা-পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ
যে নিম্নের দিকেই, বর্তমান খাতের কাছাকাছি পথ অবলম্বন করে গিয়েছিল, সে
বিষয়ে সন্দেহ করবার কারণ কি?’
উইলকক্স-এর সাথে অবশ্য কপিল ভট্টাচার্য
একটি বিষয়ে গুরুতর ভিন্নমত জানান, সেটি ভাগীরথী খননের উদ্দেশ্য বিষয়ক।
উইলককস এর মতে ভাগীরথী খনন হয়েছিল সেচের উদ্দেশ্যে, কপিল ভট্টাচার্য তা
অসম্ভব মনে করেন। পৌরাণিক সাহিত্যে বৃষ্টির আশায় যজ্ঞাদির কথা বলা থাকলেও
সেচকার্যের জন্য খালের উল্লেখ কোথাও নেই; আল, বাঁধ প্রভৃতির উল্লেখ আছে
বৃষ্টির জল কৃষিভূমিতে ব্যবহার উপলক্ষে। এবং সে যুগের জনসংখ্যার ঘনত্ব, ধান
চাষের ধরণ প্রভৃতির বিবেচনায় এই যুক্তি কিছুটা গ্রহণযোগ্যও বটে। নদীখননের
পেছনে সেচ কার্যের বিকল্প কারণ হিসেবে কপিল বরং অনুমান করেন ‘ভাগীরথী নদী
খননের প্রধান কারণ ছিল গঙ্গা নদীর নাব্যতা রক্ষা করা। ভগীরথ ভাগীরথী খালটি
গঙ্গার ধারা থেকে কেটে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুরের উপত্যকায় উৎপন্ন নদীর
ইতোমধ্যেই মজাখাতগুলি অবলম্বন করে সমুদ্রের খাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত করে
দিয়েছিলেন সমুদ্র যাত্রাপথের দীর্ঘতা হ্রাস করার জন্য। পূর্ববঙ্গের
সমতটভূমি দুর্ধর্ষ অনার্যদের বাসভূমি ছিল, আর্য রাজারা ওই দেশ পরিহার করেই
চলতেন। বর্তমান চব্বিশ পরগণা, হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলা কপিলের রাজ্য ছিল,
ভাগীরথ তাকে সন্তুষ্ট করে তার বন্ধুতার সাহায্যে পৌর্তিক কাজ শেষ করতে
পেরেছিলেন। এত বড় পৌর্তিক কাজের মাহাত্ম্য কীর্তিত হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি
আছে?
যাহোক, পদ্মা গঙ্গার আদি প্রবাহ নয়, সে
বিষয়ে উইলকক্স-এর সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন আরেক নদী-প্রকৌশলী এস সি
মজুমদার। কপিল ভট্টাচার্যের বয়ানে ‘পদ্মার চেয়ে ভাগীরথীর প্রাচীনতা
প্রমাণের জন্য শ্রীমজুমদার এস সি
মজুমদারের নিজস্ব একটি বৈজ্ঞানিক ‘যুক্তি’র অবতারণা
করেছেন: পদ্মা-মেঘনার দিকের অপেক্ষা ভাগীরথীর দিকে গঙ্গার ব-দ্বীপ
বঙ্গোপসাগর অভিমুখে দৈর্ঘ্যে বড়।’ কিন্তু মজুমদার এর এই যুক্তি কপিল মেনে
নেননি এই কারণে যে, বর্তমান ভাগীরথী-হুগলির দিকে গঙ্গার ব-দ্বীপ সৃষ্টিতে
দামোদর, রূপনারায়ণ, কাঁসাই প্রভৃতি বহু প্রাচীন নদ-নদীর হাত রয়েছে। সত্য
বটে তাদের অববাহিকা গঙ্গার তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু এরা পৃথিবীর প্রাচীনতম
ভূখ- ছোটনাগপুরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উদ্ভুত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ বছর ওই
অঞ্চলকে ক্ষয়িত করে বঙ্গোপসাগরে মাটি ফেলেছে। তারা যখন কাজ করেছে, তখনও
হিমালয়ের জন্ম হয়নি। জন্মগ্রহণ করে হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গোর তুষার জমে উঠতেও
বহুশত বছর লেগেছে, তারপর সেই সব গলিত তুষারের জল ক্রমশঃ হিমালয়ের প্রস্রবণ ও
নদীগুলির সৃষ্টি করেছে। গঙ্গা-যমুনা-ঘর্ঘরা-কুশীর জন্ম হয়েছে আরও পরে।
‘পরবর্তী যুগে ভাগীরথীর সৃষ্টির পর, সেই
পূর্বতন ব-দ্বীপের উপরে ভাগীরথীর পলি পড়েছে। সুতরাং এদিকে গঙ্গার দৈর্ঘ্য
বৃদ্ধিতে ভাগীরথী-হুগলির যতটা হাত ছিল বলে শ্রী মজুমদার ধরে নিয়েছেন, তা
ঠিক নয়।’ তিনি দেখিয়েছেন, নানান নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও মেঘনা-পদ্মার
মুখের অঞ্চলে বদ্বীপের দৈর্ঘ্য বাড়েনি। এমনকি সমুদ্রস্থিত পলিমঞ্চের ধ্বসের
ফলেও পূর্বাংশে বদ্বীপের আকৃতি হ্রস্বকায় হয়েছে বলে কপিল উল্লেখ করেছেন।
বরিশাল জেলার ইতিহাস নামের গ্রন্থেও এই পলিমঞ্চের পতনের কারণে সাগরের ‘গান’
বলে কথিত শব্দের উল্লেখ আছে, যদিও আজকাল আর এই শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু
সমুদ্রগর্ভে বদ্বীপের আকার দিয়ে কেন নদীর পলি সঞ্চয়ের প্রাচীনত্ব মাপা যাবে
না, তার পক্ষে চূড়ান্ত যে যুক্তিটি কপিল ভট্টাচার্য দিয়েছেন, সেটিও ভাববার
মতই একটি ভৌগোলিক পর্যবেক্ষণ: ‘ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত বঙ্গোপসাগর,
মার্তাবান সাগর ও শ্যাম সাগরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, ইরাবতী-সিটাং ও
মেনাম-চাও-ভ্রায়া নদীর মোহনাগুলির মানচিত্র একটু নিবিষ্টভাবে দেখলে একটি
বিষয়ে তাদের সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। তিনটি মোহনারই পূর্ব দিকের অংশে
ব-দ্বীপ পশ্চিম দিকের অংশের চেয়ে ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে বেশী দূর ঢোকানো। আমার
মনে হয়, যুগ যুগ ধরে জোয়ারের জলের দৈনন্দিন দুই বারের ক্রিয়া তাদের
তিনটিকেই এই এক রকম আকৃতি দিয়েছে। পৃথিবী তার মেরুদণ্ডে পশ্চিম থেকে পূর্বে
ঘোরে, কাজেই জোয়ারের গতি পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তাই পূর্বের ব-দ্বীপের মুখ
ভেঙে এনে সমুদ্রের জল ব-দ্বীপের পশ্চিমাংশে মুখের বৃদ্ধি সাধন করে। তাই
পশ্চিমাংশে সাগর দ্বীপ প্রভৃতি গঙ্গার মোহনার দ্বীপগুলি পূর্বাংশের
সন্দ্বীপ, হাতিয়া প্রভৃতি দ্বীপের চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর।’ (অধুনা
সুন্দরবনের নিচে আর পলিসঞ্চয় তেমন একটা ঘটছে না, মানুষের হস্তক্ষেপ এবং
কিছুটা বদ্বীপের টেকটনিক সঞ্চালনের ফলে, খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন
জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অন্তর্জালিক বন্ধু দীপেন ভট্টাচার্য– প্রাবন্ধিক) ।এভাবে কপিল ভট্টাচার্যের যুক্তি অনুযায়ী বাংলা বদ্বীপের পশ্চিমাংশের ভূমি গঠিত হয়েছে গঙ্গা নদীরও জন্মের পূর্ববর্তী ছোটনাগপুর বিধৌত নদীসমূহ দিয়ে এবং পশ্চিমাংশের সমুদ্রঅভ্যন্তরে বেশিদূর বৃদ্ধি ভাগীরথী শাখার প্রাচীনত্বের কারণে অতিরিক্তকাল পলিসঞ্চয় নয়। পশ্চিমাংশের ভূভাগ প্রাচীন বটে, তবে তা ছোটনাগপুরের পাথুড়ে শিলাদ্বারা গঠিত। গঙ্গাবাহিত পলি দিয়ে প্রধানত গঠিত হয়েছে কেবল দ্বীপের পূবভাগেরই একটি অংশ। ফলে আদি¯স্রোত বিষয়ক ধারণাটি আর মীমাংসিত থাকে না।
যায় হোক এবার আমরা শেষ কথাতে আসি। পদ্মাই গঙ্গার আদি খাত-এই কথা বলতে আর কোন দ্বিধা থাকে না। কারণ টলেমি গঙ্গা নদীর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে দেখা যায় প্রাচীন গঙ্গা নদী প্রায় ২০০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান গোয়ালন্দ থেকে অনেক উত্তরে ঢাকা ভাওয়ালের পাশে ‘এ্যান্টিবোল’ হয়ে প্রবাহিত হতো। তখন ঐ অঞ্চলকে ‘এ্যান্টিবোল সাগর’ বলে পরিচিতি রয়েছে (জেমস টেলর)। জনশ্রতি ও ঐতিহাসিক বিবরণে সেখানে কালিদহ আর লোহিত্য নামের দুটি সাগরের নাম পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ জেলার টেকেরঘাটে চুনা পাথর ও একধরনের ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়, যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবালদ্বারা সৃষ্ট। এগুলো থেকে সে অঞ্চলে সমুদ্রের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তৎকালীন সময়ে গঙ্গার উত্তর হতে সরাসরি দক্ষিণে করতোয়ার দক্ষিণাংশ এ অঞ্চলের হড়াই নদী বলে পরিচিতি ছিল। এ নদী খুবই বেগবান ছিল। আমরা যদি উপমহাদেশের বড় বড় নদী সমূহের গতিপথ পর্যবেক্সন করি তাহলে দেখব যে, নদী সমূহ সমুদ্র যাত্রা কালে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভাগীরথী পদ্মার চেয়ে উচ্চ স্থানে প্রবাহিত। আর তাই ভাগীরথীকে মূল খাত/আদি খাত মনে করার কোন কারণ নাই। পদ্মার মোহনার দুই পাশের ভূমি অপেক্ষকৃত উচুতে অবস্থিত। প্রাচীন মানচিত্রে আমরা দেখি যে পূর্বে চট্টগ্রাম আরো পশ্চিমে ছিল। পলি পড়ে পদ্মা খাত সংকীর্ণ হলে গঙ্গা খাত পরিবর্তন করতেই পারে। গঙ্গা বার বার খাত পরিবর্তনের ফলে হয়ত কোন এক সময় ভাগীরথী দিয়ে মূল প্রবাহ প্রবাহিত হত, কিন্তু সেটা আদি কিংবা চিরন্তন না।
প্রাকৃতিক নিয়মে গঙ্গা পদ্মার খাত ছেড়ে হয়ত কোন এক সময় ভাগীরথীর পথে প্রবাহিত হত। কিংবা ভাগীরথ কর্তৃক ভাগীরথী খাল খননের পর গঙ্গা তা খাত পরিবর্তন করে ভাগীরথীর পথ অবলম্বন করে। পরে আবার গঙ্গা ভৈরব, জলঙ্গি, মাথাভাঙ্গা,কুমার,গড়াই প্রভৃতি পথ পরিহান করে পদ্মায় ফিরে আসে।
ফারাক্কা বাঁধঃ
ভাগীরথী-হুগলীর নাব্যটা সঙ্কট মেটানোর জন্য ১৯৭৫ সালে ভারত ফারাক্কা বাধঁ চালু করে। এতে বাংরাদেশের নদ-নদী গুলি শুকিয়ে মরতে বসেছে। উত্তরাঞ্চল, বিশেষত বরেন্দ্র ভুমি আজ মরুভুমিতে পরিণত হবার প্রহর গুনছে। পানির স্তর অনেক কেমে গেছে। আমাদের চারঘাটে শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলনের ফলে আর্সেনিক ছড়াচ্ছে এই অঞ্চলে। ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি হয়েছে তবে বাংলাদেশ তার নায্য পানির হিস্যা পাচ্ছে না। ভারত জুড়ে গঙ্গা কেন্দ্রিক সেচ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ একেবারে কমে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ পানির নায্য হিস্যা পাচ্ছে না।
সাপ্তাহিক একতা পত্রিকায় গত ২৬ মার্চ, ২০১৭ তারিখে সাইফুল ইসলামের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়েছে ফারাক্কা বাধেঁর পুরো বিষয়টি। নিচে সেটি হুবহু প্রকাশ করা হল।
সাইফুল ইসলাম : ভাটির দেশ বাংলাদেশ। হিমালয় পর্বতশ্রেণিতে উদ্ভূত নদীগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়েই এসে মিশেছে সমুদ্র। ভাটির দেশ হওয়ায় উজানের দেশগুলোর যে কোনো নদী শাসন ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ওপর, যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো গঙ্গার বুকে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় হুগলি নদীতে পলির আস্তরণ জমতে থাকে ব্রিটিশ সরকারের শাসনামল থেকেই। এ পলি পরিষ্কার ও কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কিভাবে হুগলির দিকে ফেরানো যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৮৫১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে এ নিয়ে অন্তত: পাঁচটি সমীক্ষা চালানো হয়। এরপর ব্রিটিশ চলে গেলে, এ চিন্তাভাবনার দায়ভার বর্তায় ভারত সরকারের ওপর। শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ মহলের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয় ফারাক্কা বাঁধ। পশ্চিমবঙ্গের এক সময়কার চিফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এ পরিকল্পনার বিরোধিতা করে বলেন- ১. গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০,০০০ কিউসেক পানি ফিডার খাল বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না। ২. গঙ্গা ও ভাগিরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালণ কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজে নেবে। ৩. প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা জুড়ে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে। ৪. ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতিশক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরণের নদীর গতিপথ আঁকা-বাঁকা। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগিরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগিরথী ও উজানে বিহার পর্যন্ত সবগুলো নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ওইসব নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন ও চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে। ৫. ভাটি অঞ্চলের সব নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হবে। ৬. শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনেরও আশঙ্কা রয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কপিল ভট্টাচার্যের সবগুলো আশঙ্কাই এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। ২ হাজার ২৪০ মিটার (৭ হাজার ৩৫০ ফুট) লম্বা বাঁধটি তৈরি হয়েছিল ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ে। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহায়তা বাঁধের নির্মাণ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। ওই বছরেরই ২১ এপ্রিল থেকে চালু হয় বাঁধটি। ফারাক্কার বর্তমান অস্তিত্বের শুরুটাই হয়েছিল একটা মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে। ৪১ দিনের জন্য চালু হওয়া বাঁধ এখন চালু রয়েছে ৪২ বছর ধরে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয়, শুষ্ক মৌসুমে অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে ফারাক্কা পয়েন্টে (ব্যারাজের ভাটিতে) ৪৪ হাজার কিউসেক পানি (১ কিউসেক = প্রতিসেকেন্ডে প্রবহমান এক ঘনফুট পানি) পাবে বাংলাদেশ। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ১৯৭৫ সালের ৩১ মে। দুই দেশের মধ্য একটি সমঝোতা ছিল যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিতে সই না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধের ফিডার ক্যানেলটি পরীক্ষা করা প্রয়োজন বলে জানায় ভারত। ওই বছরের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা থেকে ৩১০-৪৫০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড গঙ্গার প্রবাহ প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশের অনুমতি দাবি করে। বাংলাদেশও এতে সায় দেয়। ভারত বাঁধ চালু করে এবং নির্ধারিত সময়ের পরেও একতরফাভাবে গঙ্গার গতি পরিবর্তন করতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের দিকেও তা একতরফাভাবে চালু থাকায় বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক সর্বসম্মত বিবৃতির মাধ্যমে সমস্যার ন্যায্য ও দ্রুত সমাধানের জন্য ভারতকে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক দফায় আলোচনার পর ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর শুষ্ক মৌসুমে পানি বণ্টন নিয় দুই দেশের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি (১৯৭৮-৮২) একটি চুক্তি সই হয়। এরপর ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে ভারতের সঙ্গে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। কিন্তু ১৯৮৯-৯৬ পর্যন্ত গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। ওই সময়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফারাক্কায় বাঁধ পড়ার আগে প্রতি বছরের মার্চে হার্ডিঞ্জ সেতুর কাছে যেখানে গঙ্গার (পদ্মা) প্রবাহ ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৯৮০ কিউবিক মিটার, ১৯৯৩ সালের একই সময়ে তা নেমে আসে মাত্র ২৬১ কিউবিক মিটারে। এরপর ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ৩০ বছর মেয়াদি একটি পানি বণ্টন চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ ৭০ হাজার কিউসেক হলে দুই দেশ তা সমানভাগে ভাগ করে নেবে। পানি প্রবাহ ৭০-৭৫ হাজার কিউসেক হলে সেখান থেকে বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক ও অবশিষ্টাংশ পাবে ভারত। পানি প্রবাহ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত পাবে ৪০ হাজার কিউসেক এবং অবশিষ্ট বাংলাদেশ। এ চুক্তিটি বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশে পদ্মাসহ এর শাখানদীগুলোর জলজ ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। গঙ্গার প্রবাহ কমায় পলি জমে নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষায় যখন ফারাক্কার সবগুলো স্লুইস গেট খুলে দেয়া হয়, সারা দেশে দেখা দেয় তীব্র বন্যা। গত বছরও দেখা গেছে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বন্যার সময় বসতভিটা নষ্ট হয়ে পড়াসহ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়ে মানুষ। নষ্ট হয়ে যায় আবাদি ফসল, প্রাণ যায় গবাদিপশুর, এ সব কিছুতেই রয়েছে ফারাক্কার নেতিবাচক ভূমিকা। ফারাক্কায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিরূপ প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, কৃষি, লবণাক্ততা, নৌপরিবহন, মৎস্য ও বনজসম্পদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বাঁধটির কারণে দেশের গোটা উত্তরাঞ্চল জুড়ে চলছে মরুকরণ। বিনষ্ট হতে চলেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি। শুকনো মৌসুমে উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে ভাটিতে বাংলাদেশে পদ্মার প্রবাহ কমে যায়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। একই সঙ্গে ভরাট হয়ে পড়ে নদীর তলদেশ। অথচ কৃষিতে পানি প্রয়োজন। ফলে এ সময় কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানি গভীর নলকূপ দিয়ে ওই নেমে যাওয়া স্তর থেকেই টেনে এনে ব্যবহার করতে হয়। গভীর থেকে টেনে আনা এসব পানি মাটির নিচ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতু, যা হয়ে উঠছে জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। গত দশকে দেশের জনস্বাস্থ্যে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার প্রভাব এত তীব্র আকার ধারণ করে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে আখ্যা দেয় ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণবিষপ্রয়োগ’ হিসেবে। মনুষ্যসৃষ্ট এ দুর্যোগ চালু রয়েছে এখনো। পদ্মা ও তার শাখা প্রশাখাগুলো এখন আগের তুলনায় নাব্যতা হারিয়েছে অনেকাংশেই। ফারাক্কার কারণে এখন শুকিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় অনেক ছোট ছোট নদী। গড়াই, মধুমতির মতো এককালের প্রমত্তা নদী শীতের সময় ক্ষীণ ধারায় পরিণত হয়। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদে আধার সুন্দরবন গড়ে উঠেছে নদী ও সাগরের সঙ্গমস্থলে নোনামিঠা পানির মিশ্রণের (ব্র্যাকিশ) ওপর। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের কারণে উজানি মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়া এখানকার জলে লবণাক্ততা বেড়ে যায় অত্যাধিক, যা সুন্দরবনের শ্বাসমূলজাতীয় উদ্ভিদের জন্য হানিকর প্রমাণিত। কিছুদিন পরই সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে চালু হতে যাচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। একদিক থেকে ফারাক্কা, অন্যদিক থেকে রামপাল; এ দুই মধূ-কৈটভে এবার সুন্দরবনটাকে নিশ্চিত গিলেই খেতে যাচ্ছে। আসলেই মানুষের চেয়ে নির্বোধ প্রাণী আর হয় না। ফারাক্কা গঙ্গা-পদ্মার জলজ সম্পদের ওপরেও ফেলছে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। বাঁধটির কারণে এর দুপাশের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ একে অপরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে একই সঙ্গে এসব মৎস্য ও প্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে প্রজনন ক্ষেত্রও। নদীর ডলফিন শুশুকের বিপন্নতার মূলে ফারাক্কার অবদান কম না। কয়েক বছর আগে শুধু ফারাক্কার কারণে প্রত্যক্ষ ক্ষতির হিসাব করা হয়েছিল ৩০০ কোটি ডলার। পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব করলে এ ক্ষতির হিসাব যে কততে দাঁড়াবে, তা বলা মুশকিল। অথচ এ বাঁধ যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষতি করছে, তা নয়। ভারতকেও পোহাতে হচ্ছে এ শ্বেতহস্তি পোষার খেসারত। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক আর জলবায়ু পরিবর্তন কখনো কোনো দেশের সীমানা মেনে থাবা বসায় না। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় হুগলী-ভাগিরথীতে বিশাল জলবদ্ধতা সৃষ্টি করছে ফারাক্কা। এতে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়েছে। একই সঙ্গে বিস্তার লাভ করেছে ম্যালেরিয়ার মত প্রাণঘাতি রোগ। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে নদী ভাঙ্গণের কারণে চর জাগার পরিমাণ বেড়েছে অনেক। প্রতি বছর মালদহে নদীর তলদেশ বাড়ছে ৫০ সেমি হারে। মানিক চাক ঘাটের কাছে গঙ্গার গভীরতা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ ফুটে। এতে পানি প্রবাহ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়ে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বন্যার সময় কালিন্দি নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে মহানন্দা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। বিহারে এখন প্রতি বছর বন্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধকেই দায়ী করা হচ্ছে। প্রদেশটিতে শুধু গত বছরের বন্যাতেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ২০ লাখ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে নালিশও জানিয়েছেন। মোদিও তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস জানিয়েছেন। অবিশ্বাস্যভাবে, ওই সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আবার সোচ্চার হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ থাকলেও, এ বিষয়ে মুখ খুলতেই চায়নি ঢাকা। ফারাক্কা আসলে যতটা বাঁধ, তার চেয়ে অনেক বড় ফাঁদ। এ পাতা ফাঁদে বাংলাদেশ তো পা দিয়েছেই, এখন ভারত নিজেও তাতে আটকাতে যাচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে। এখন ভারতেরও সময় এসেছে বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার, তাতে সবারই মঙ্গল।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ
গঙ্গা, পদ্মা, পদ্মাবতী-মাহাবুব সিদ্দিকী
উইকিপিডিয়া
বাংলা পিডিয়া
ফিরোজ আহমেদ; ওমকার ব্লগ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন