চারঘাট-বাঘার হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীঃ গঙ্গামতি, ঝিনি, ত্রিমহনী ও কাটা বড়াল


বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃক দেশ। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় অসংখ্য নদী। অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় বৃহত্তর চারঘাটের চারঘাট-বাঘা-কাটাখালি থানার বুক চিরে এক সময় বয়ে যেত অনেক গুলি নদ-নদী। কালের বিবর্তনে এসব নদীর অনেক গুলি মরে, আবার যেগুলা আছে সেগুলাও নাব্যতা হারিয়েছে। চন্দনা, খালিসিডিঙ্গি, মহানন্দা, গঙ্গামতি, নারদ, ঝিনি, ইছামতি, ছোট বড়াল, মুসা খান, ত্রিমহনী প্রভৃতি নদীর অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। হারিয়ে যাওয়া এমন কিছু নদীর তথ্য থাকছে আজকের ব্লগে।
গঙ্গামতিঃ
উৎসঃ বড়াল নদ
মোহনাঃ চন্দনা নদী (রাজশাহী)
ক্ষমতার মোড়ে গঙ্গমতির মৃত খাত

ডাকরা বাজারের কাছে গঙ্গামতির মৃত খাত। বর্তমানে এটি একটি দহের আকার ধারণ করেছে।

গঙ্গামতি নদীটি ভায়া লক্ষীপুর ইউনিয়নের জাহাঙ্গীরাবাদ এলাকায় বড়াল থেকে উৎপত্তি লাভ করে। এর সামান্য পূর্বে পুঁটিমারী বাজার। অনেকেই পঁটিমারী বাজারের নিকট একটি অখ্যাত খালকে গঙ্গামতির উৎস মনে করে থাকেন। আসলে এটি একটি প্রাকৃতিক খাল যা নাকি কয়েক বছর পূর্বে পানির স্রোতে সৃষ্টি হয়। নদীর উৎস মুখের কাছে একটি কালভার্ট আছে; পাশেই জাংলি বাজার। নদীর উৎপত্তি নিয়ে স্থানীয়দের কাছে কিছু মনোমুগ্ধকর কাহিনী আছে। পূর্বে জাহাঙ্গীরাবাদ এলাকায় একটি ছোট নালি ছিল যা দিয়ে কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতে সেচ দিত। কয়েকশত বছর পূর্বে বড়াল/গঙ্গার বন্যার তোড়ে ক্ষেতে পানি দেওয়ার নালি নদীর আকার ধারণ করে বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এভাবেই নদীর সৃষ্টি। বড়াল তখন গঙ্গা নামে পরিচিতি ছিল। গঙ্গার ইচ্ছায় রাতারাতি নদীর সৃষ্টি হয়েছে বলে এর নাম ‘গঙ্গামতি’; অর্থাৎ গঙ্গার ইচ্ছা। গঙ্গামতি জাহাঙ্গীরাবাদ, পুটিমারীর বিল অতিক্রম করে বাটিকামারী গ্রামে প্রবেশ করে। এখান থেকে আড়াআড়ি ভাবে অবস্থিত দুইটি রাস্তার নিচ দিয়ে ডাকরার দিকে চলে গেছে। পথিমধ্যে গঙ্গামতি লগোর বিলের মাঝ দিয়ে  বাতান, কটরা প্রভৃতি গ্রাম অতিক্রম করে। ডাকরার কাছে এসে ডাকরা ও লক্ষীপুরের সীমানা নির্দেশ করে। ডাকরার কাছে এসে বাঁক নিয়ে নদী পশ্চিম দিকে বাকরার নিকট চলে যায়। এরপর গঙ্গমতি আরো দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে মনিগ্রাম উপজেলার তুলসিপুর গ্রামে ব্রিজের নিকট গঙ্গার শাখা চন্দনা নদীর সাথে মিশেছে। এরপর মিলিত ধারা বাউসা ইউনিয়নের বিলাঞ্চলে গিয়ে খালসাডিঙ্গি ও চন্দনা লোয়ার নদীর সাথে মিশে চন্দনা নামে লালপুর উপজেলায় প্রবাহিত হতে থাকে। পথিমধ্যে গঙ্গামতি ছোট বড়াল ও ইছামতির পানি ধারণ করে।


উৎস থেকে মেনজানের বাড়ি পর্যন্ত নদীর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট  নাই। আর ডাকরা থেকে বাকরা পর্যন্ত নদীর চিহ্ন এখনো বর্তমান। এখানে নদী বড় বড় দহ ও পুকুরে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা সরকারের নিকট লিজ নিয়ে এখানে মাছ চাষ করে।ধারণা করা হয় যে বহু পূর্বে নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে। তবে ৩০-৪০ বছর আগেও এই নদী খালের ন্যায় পানি নিষ্কাশনের কাজ করত। বর্ষাকালে নৌকাও চলত। আর সারা বছর সামান্য হলেও পানি থাকত। বয়স্ক ব্যক্তিরা জানান ৬০-৭০ বছর পূর্বে তাঁরা এই নদীর স্রোত দেখেছেন। বর্ষাকালে বড় নৌকা আর সারা বছরই ছোট নৌকা চলাচল করত। ছোট আকারের এই নদীটি ফারাক্কা ও চারঘাট স্লুইচ গেট নির্মাণের পর ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে। নদী মরে যাওয়ায় চারঘাট, ভায়ালক্ষীপুর, মনিগ্রাম ও বাউসা ইউনিয়নের জমি থেকে বর্ষার পানি আর নামতে পারছে না। গত বর এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। আবার পানি না থাকায় দেশীয় মাছের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। নদী খনন করলে মাছের উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনি বর্ষার পানি সহজেই নামতে পারবে। আবার এই পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে কাজে লাগানো যাবে।
আরো দেখুনঃ পদ্মা নদী

ঝিনি নদীঃ
উৎসঃ বড়াল নদ
মোহনাঃ মুসা খান নদ

চারঘাটের যে নদী গুলি মৃত বলে বিবেচিত তার মধ্যে ঝিনি অন্যতম। এই নদীর উৎস শিমুলিয়া ব্রিজের ২০০ গজ পূর্বে জোত কার্তিক নামক গ্রামে বড়ালের বাম তীর থেকে। আর মোহনা চারঘাট-বাঘাতিপাড়া সীমান্তে পকেটখালির নিকট। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর পুরোটাই চিহ্নিত কিন্তু কোথাও প্রবাহ নেই চারঘোটে স্লুইচ গেটের কারণে নদীটি মরে গেছে। পূর্বে নদীতে বড় বড় ঝিঁনুক পাওয়া যেত বলে নাম হয়েছে ‘ঝিনি’ নদী। ঝিনি নদীটি জোত কার্তিক থেকে উৎপন্ন হয়ে নন্দনগাছী, নিমপাড়া,হাবিতপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর ঝিনি উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পুঠিয়া- আড়ানী মহাসড়কের নিকট পকেটখালিতে গিয়ে মুসা খানের সাথে মিশেছে। তবে ঝিনি নদীর প্রবাহ পথ পূর্বে এমন ছিল না। ১৮৩৮ সালের আগে মুসা খান আলাদা কোন নদী ছিল না। জমিদার ‘ঈশা খানে’র পুত্র মুসা খান নারদ আর বড়ালের মাঝে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এই খাল খনন করেন যা নাকি ঝিনি আর নারদের সংযোগ ঘটিয়েছিল। ১৮৩৮ সালে গঙ্গার বন্যায় বড়ালের পানি বৃদ্ধি পেয়ে খালটি প্রশস্ত হয়ে আরো উত্তরে প্রবাহিত হতে থাকে; তখন থেকেই এটি নদী। এরপর থেকে ঝিনি নদীর মোহনার আধা কিলোমিটারের মত অংশ মুসা খানের মাঝে বিলীন হয়ে যায়। এখন ঝিনি নদীর মোহনা মুসা খান আর ১৮৩৮ সালে পূর্বে ছিল ত্রিমহনীর নিকট বড়ালে।

বড়ালের এই স্থান থেকেই জন্ম ঝিনি নদীর

মোহনায় মুসা খানের সাথে মিশছে ঝিনি নদী

মোহনায় সামান্য পানি নিয়ে মুসা খানের সাথে মিশছে ঝিনি নদী।
ঝিনি বেশ নাব্য নদী ছিল তবে, সারা বছর নৌকা চলাচল করত। ভারত গঙ্গার উজানে ফারাক্কা বাঁধ দিলে বড়ালের প্রবাহ কমতে থাকে। নাব্য সংকটে পরে ঝিনি। পরে চারঘাটে স্লুইচ গেট দিলে মরে যেতে থাকে নদীটি। নদীটি বর্তমানে খালের ন্যায় বিলের অতিরিক্ত পানি বহন করছে। স্লুইচ গেট খুলে দিলে আবারো প্রান ফিরে পেতে পাবে ঝিনি।
আরো দেখুনঃ নারোদ নদী
ত্রিমহনীঃ
উৎসঃ নিমপাড়া বিল
মোহনাঃ বড়াল নদ
আড়ানী-পুঠিয়া রাস্তার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ত্রিমোহনী

ত্রিমোহনী নদীর উৎপত্তি চারঘাটের নিমপাড়া বিলে। বিলে বিশাল পরিমাণ পানি বহন করে নদীটি ঝিনি নদীর সাথে মিশে বড়ালে পতিত হয়।তিনটি নদী একি স্থানে মিলিত হচ্ছে বলে এই স্থান ‘ত্রিমোহনী’ নামে পরিচিতি পায়। আর নতুন এই নদীর কারণে ত্রিমোহনীর সৃষ্টি হল বলে এটিও ‘ত্রিমোহনী’ নামে সবাই ডাকতে থাকে। বর্তমানে নদীটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। পূর্বে ঝিনি নদীর পানি নিমপাড়া বিলে গিয়ে পানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করত। দেশীয় মাছে পরিপূর্ণ ছিল নিমপাড়া বিল। সেই বিলের অতিরিক্ত পানি ছিল এই নদীর মূল উৎস। কিন্তু স্লুইচ গেটের কারণে নদীটি মরে যেতে থাকে। বিলের মাঝ দিয়ে রাস্তা তৈরি হওয়ায় নদীটি এখন মৃত নদীতে পরিণত হয়। নদীটি সংস্কার করা হলে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে সেচ ও বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত পানি বড়ালে গিয়ে পড়বে।
আরো দেখুনঃ চারঘাটের বড়াল নদী

ছোট / কাটা বড়ালঃ
উৎসঃ বড়াল নদ
মোহনাঃ গঙ্গামতি নদী
অনুপমপুরে ছোট বড়ালের মৃত খাত যা এখন কানার বিল নামে পরিচিত

এই নদীর উৎস চারঘাট পৌরসভার মেরামতপুর গ্রামে বড়ার নদে। আর মোহনা বাকরার নিকট গঙ্গামতি নদীতে। এই প্রাকৃতিক প্রবাহ নাকি খনন করা হয়েছে সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বর্তমানে চারঘাট পৌরসভা মেরামতপুর অংশে নদীটি খনন করে বৃহৎ একটি ড্রেন তৈরি করেছে। উপরের নদী গুলির থেকে এর বৈশিষ্ট্য বেশ ভিন্ন। গঙ্গামতি, ত্রিমহনী ও ঝিনি নদীতে এক সময় বড় বড় নৌকা চলত বলে প্রবীন লোকেরা জানান। আবার এগুলা এখন খাল কিংবা দহের আকার ধারণ করলেও এক সময় যে নদী ছিল সেটা অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে কাটা বড়াল সম্পর্কে কারো তেমন ধারণা নাই। এই নদীর ব্যাপারে কেউ তেমন একটা কিছু বলতে পারে না। ফলে এটি নদী নাকি খাল তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। তবে বিখ্যাত নদী গবেষক ‘মাহবুব সিদ্দিকী’ নিশ্চিত করেছেন যে এটি একটি নদী। তাহলে হয়ত এই নদী বহু পূর্বে সচল ছিল কিংবা নদীটি মৌসুমী প্রকৃতির ছিল। আর তাই জনসাধারণের নিকট এর কোন তথ্য নাই। কথিত আছে যে চৌধুরী বংশের জোতদাররা এই নদীটি বড়াল থেকে কেটেছিল তাঁদের নৌ পরিবহন ও সুরক্ষার কথা চিন্তা করে। অনুপমপুর বিলের নিকট নদী থেকে আরেকটি প্রশস্ত শাখার চিহ্ন রয়ে গেছে যা আবার মূল নদীর সাথে মিশে গেছে। এসব দেখে অনুমান করা হয় যে এটি খনন করা নদী, প্রাকৃতিক না। রাজবাড়ির এক পাশে নদী আর আরেক পাশে প্রশস্ত একটি খাল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে আস্তে আস্তে নদীটি মরে গেছে।
এটি চৌধুরী বংশের রাজ বাড়ির সামনের অংশ। সামান্য দূর থেকে দেখলে এখানে নদীর খাত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নিরাপত্তার খাতিরে কাটা বড়াল থেকে এই অংশটি খনন করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কিছু দূর গিয়ে এটি আবার মূল নদীতে মিশত।
আরো দেখুনঃ মুসা খান নদী
ব্লগ লিখেছেনঃ
মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি
সভাপতি; পদ্মা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ
সহযোগীতায়ঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম
দপ্তর সম্পাদক; পদ্মা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ
জনাব মোঃ মাহবুব সিদ্দিকী
নদী গবেষক ও সভাপতি হেরিটেজ রাজশাহী

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

চারঘাটের নদ-নদী, ১ম পর্বঃ গঙ্গা/পদ্মা নদী (Ganges/Padma River)

বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী/একাডেমি, সারদা (Bangladesh Police Academy)

সরদহ সরকারী/সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় (Sardah Govt. Pilot High School)