ইতিহাসের ভুলে যাওয়া শর্মা রাজার কাহিনি
হারিয়ে যাওয়া চন্দনা আর শর্মা রাজার কাহিনিঃ চন্দনা নদীর কথা বললেই প্রথমেই মনে আসবে রাজবাড়ির চন্দনা নদীর কথা। রাজবাড়ির এই নদীর জন্ম পদ্মা নদী থেকে। কিন্তু রাজশাহী জেলাতেও 'চন্দনা' নামের পদ্মার একটি শাখা নদী ছিল। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া গঙ্গার এই শাখা নদীর গতিপথ খুঁজতে ২০১৭ সালে গেছিলাম চারঘাটের এক নিভৃত বিলাঞ্চলে। 'চৌকিরপাড়' নামক এক স্থানে যেয়ে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। জনমানবশূন্য এক বিলাঞ্চল। নদীর খাত এখনো বর্তমান। নদীর খাতে বড় বড় দীঘি বানানো হয়েছে। ভূতুরে এলাকার আরো ভিতরে যেতেই সন্ধান পেলাম একটি প্রাচীন রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। আব্দুল জলিল (৭৮) নামের এক প্রবীণ বৃদ্ধ জানালেন এটা শর্মা রাজার বাড়ি। পুরো নাম কারো জানা নাই। অনেক আগেই এই রাজবাড়ী মাটির নিচে দেবে গেছে। ওপরে এখন আম বাগন করা হয়েছে। রাজবাড়ীর পূর্ব দিকে একটি প্রাচীন পুকুর আছে। এটা হয়ত মল পুকুর হিসেবে ব্যবহৃত হত। রাজবাড়ীর মহিলারা একটা সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমে পুকুরের ঘাটে এসে পৌঁছাতেন। নিজেদের কাজ সস্পূর্ণ করে আবার অন্দর মহলে চলে যেতেন। মহলের উত্তর দিকে আছে শিব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এটা রাজ পরিবারের মন্দির ছিল। রাজবাড়ীর চারিপাশে পরিখা খনন করা আছে। আর উত্তর দিক দিয়ে বয়ে চলা চন্দনা নদীতে রাজার 'নৌ সেনারা' পাহাড়ারত থাকতেন। একটা কাটা খালের মাধ্যমে নদীর সাথে রাজার পরিখার সংযোগ ছিল। রাজার বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছা হলে তিনি পরিখায় তাঁর নৌযানে এসে বসতেন। সেখান থেকে নদী পথে তাঁর নৌ বহর বিভিন্ন স্থানে গমন করত। রাজার আরো একটা অদ্ভূত শখ ছিল। রাজার ভিটা দিয়ে কেউ চলাচল করলে তাকে অবশ্যই ৫ ডালি মাটি কেটে তারপরই যেতে হবে! কথিত আছে যে, শর্মা রাজার গুরু, পুঠিয়া ৪ আনি কিংবা ৫ আনি জমিদার বাড়ির প্রধান পুরোহিত এক ব্রাহ্মণ এই পথে গঙ্গাযাত্রা করার সময় শর্মা রাজার ভিটেয় উপস্থিত হন। রাজা তাঁর দীক্ষা গুরুকে ৫ ডালি মাটি কেটে তারপর তাঁর ভিটে ত্যাগ করতে বলেন! এমন নির্দেশে গুরু ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিষাপ দেন যে রাজার বংশ নির্বংশ হবে। এই ভিটেতে আলো দেওয়ার কেউ থাকবে না। কথিত আছে যে এরপরে রাজার পুত্ররা একে একে মুখে রক্ত উঠে মারা যান। বৃদ্ধ রাজাও এক সময় মারা যান। বাড়ির বাকি সদস্যরাও মারা গেছেন কিংবা বাড়ি ত্যাগ করেছেন। কথিত কিংবদন্তি অনুযায়ী রাজ পরিবারের সবাই মারা গেছেন। রাজবাড়ির নারী সদস্যদের নিয়ে রাজা শর্মা কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বড় একটা নৌকাতে করে চন্দনা নদী দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। নৌকাতে ছিল কলসি ভর্তি স্বর্ণ মুদ্রা আর সোনার গহনা। চন্দন শহরের নিকট নৌকা পৌছালে প্রচন্ড ঝড় উঠে। ঝড়ের কবলে পড়ে চন্দনা নদীতে সকলের শরীর সমাধি হয়। চন্দনায় ডুবে যায় রাজার বিশাল নৌকা। কথিত আছে যে নৌকা ডুবির পরে অনেক লোক চেষ্টা করেও কোন নৌকা বা কোন মরদেহ খুঁজে পায়নি। পরে অনেকে নদীর তলদেশে নৌকার সন্ধান করতে নামে কিন্তু তারা আর কেউ জীবিত ফেরত আসেনি। স্থানীয়দের ধারণা পাতালবাসী জ্বীনেরা এই নৌকা পাহাড়া দিচ্ছে। নৌকাডুবির পর বেশ কিছু দিন পরে নৌকাটা ভেষে উঠে। নৌকা ভর্তি সোনা, আর সেই সোনা পাহারা দিচ্ছিল বিশধর সব সাপ। কোন লোক সেই নৌকার কাছে যেতে পারেনি। পরে নৌকাটি আবার পানির নিচে চলে যায়। নৌকাডুবির স্থানটি এখনো “ডিঙ্গাডোবা” নামে পরিচিতি। স্থানীয়রা এখনো সেই স্থান চিনিয়ে দিতে পারে। আরো একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে এখানে। পূর্বে এই মল পুকুরে নাকি সোনার ঢাকিতে করে, সোনার তৈজসপত্র আসত! কারো পাত্রের দরকার হলে তারা পুকুরের কাছে এসে মিনতি করলে সকাল বেলা তৈজসপত্র পুকুরে ভেসে উঠত। লোকেরা বাসন-কোসন ব্যবহার করে আবার ফেরত দিত। একবার কেউ একজন বাসন-কোসন নিয়ে ফেরত না দিলে তার অপমৃত্যু হয় আর সেই থেকে তৈজসপত্র আসা বন্ধ হয়ে যায়। আব্দুল জলিল সহ মোট দুইজন আমাকে জানিয়েছেন যে তাঁরা নিজে সোনার তৈজসপত্র পুকুরে ভেসে উঠতে দেখেছেন। অবশ্য এমন অনেক কিংবদন্তি অনেক স্থানে প্রচলিত। বাঘার শাহী মসজিদের দীঘি নিয়েও এমন কিংবদন্তি প্রচলিত। কিংবদন্তি যায় বলুক না কেন, এই রাজবাড়ীর ইতিহাস এখনো অজানা। রাজ পরিবারের ইতিহাস এলাকার মানুষের কাছে অজানা। চারঘাটের এই অঞ্চলে কোন রাজপরিবারের ইতিহাস পাওয়া যায় না। শলুয়ায় একটি রাজবাড়ী আছে তবে, এই অঞ্চলে রাজবাড়ীর কোন তথ্য প্রচলিত নাই। রাজবাড়ীর গড়ন দেখে মনে হচ্ছে যে, এটা কোন জমিদার কিংবা জোতদারের বাড়ি হবে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের গঙ্গাযাত্রার কাহিনি থেকে অনুমান করা যায় যে শর্মা রাজা উনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীর প্রথমে জীবিত ছিলেন। কারণ পুঠিয়া রাজবাড়ীর লোকেরা নারদ নদী দিয়ে গঙ্গাযাত্রা করতেন। নারদ ১৮২৫ সালে মজে গেলে অন্য রুট, যেমনঃ বড়াল কিংবা চন্দনা নদী দিয়ে গঙ্গাযাত্রা সম্পূর্ণ হত। অন্য দিকে নদী গবেষক 'মাহবুব সিদ্দিকী'র মতে চন্দনা প্রায় ১০০ বছর পূর্বে নাব্য হারিয়ে নৌ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ফলে শর্মা রাজা উনবিংশ শতাব্দীর লোক ছিল এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। শর্মা রাজা যেই সময়েরই হোক না কেন, তিনি যে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন এটা পুঠিয়া রাজ পরিবারের প্রধান পুরোহিতকে দিয়ে মাটি তোলানোর ঘটনা থেকে জানা যায়। কোন ছোট-খাঁটো জোতদার/তালুকদারের পক্ষে এই কর্ম সম্ভব ছিল না। বেশ কয়েক বছর পূর্বে জমির বর্তমান মালিক জমিটি খনন করতে চেয়েছিলেন। তখন এলাকার লোকের বিপত্তির মুখে ও প্রশাসনের বাঁধার কারণে তিনি খনন করতে পারেননি। রাজবাড়ীতে নাকি এখনো প্রচুর ধন-সম্পদ গচ্ছিত আছে। প্রচলিত কথা যায় হোক না কেন, স্থানটি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খনন করা প্রয়োজন। খনন করার মাধ্যমে রাজবাড়ী সহ অন্যান্য কাঠামো মাটির ওপরে দৃশ্যমান হবে। তখন সেখানকার সঠিক ইতিহাস ও এর সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব। যেহেতু এই এলাকায় কোন জমিদার বংশের ইতিহাস পাওয়া যায় না, তাই এই রাজবাড়ী খনন এখন সময়ের দাবি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্তাবধানে দ্রুত স্থানটি খনন করা প্রয়োজন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সারা দেশের অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থান অচিহ্নিত করে রেখেছে। অথচ এই সব স্থান চিহ্নিত করে ইতিহাস সামনে আনাটা খুব জরুরী। আরো পড়ুনঃ চারঘাটের চন্দনা নদী লেখকঃ মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি |
খুব ভালো আমরা চাই এই ইতিহাস টাকে জানতে।
উত্তরমুছুনআরো অনেক কিছু ছিল কিন্ত দিনে দিনে সব নিশেষ হয়ে গেছে জাইগাটা অনেক সুন্দর।
অনেক ভালো লাগলো। ভবিষ্যৎ এ আপনার মাধ্যমে আরো ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাদের
উত্তরমুছুন