|
দিঘা এলাকায় পুরাতন চন্দনা নদী |
|
অমরপুর এলাকায় চন্দনা নদী |
|
অমরপুর এলাকায় বালিয়াপাড়া বিল |
নদী মাতৃক বাংলাদেশে ঠিক কত নদী ছিল তার সঠিক কোন তথ্য কারো কাছে নেই । আজকের দিনে যেসব নদী আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলার বেশির ভাগই আগের তুলনায় অনেক ছোট ও শীর্ণকায় হয়ে গেছে। আর অসংখ্য নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। কোন নদী মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে; আবার কোন নদী হয়ত নাব্য হারিয়ে বিল কিংবা ছোট খালের আকার ধারণ করে শুধু বর্ষার পানি নিষ্কাশন করে চেলেছে। রাজশাহী জেলা এক সময় নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। প্রায় সব থানাতেই পদ্মা পানি পৌছে যেত অসংখ্য শাখা নদী ও খালের মাধ্যমে। বর্তমানে চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় কেবল পদ্মা ও বড়াল নদী ছাড়া আর কোন নদীর অস্তিত্ব খুঁজে বের করা দূরহ। অথচ ১০০ বছর আগে এই অঞ্চলে পদ্মা ও বড়ালের অসংখ্য শাখা নদী ছিল। আর মাত্র দুই দশক আগেও এই নদী ও খালের প্রবাহ দেখা যেত। কিন্তু এখন আর সেসব চোখে পড়বে না। এমন কিছু নদীর কথা আগের সিরিজে উল্লেখ করেছিলাম। আজকে ২য় কিস্তিতে চন্দনা নদীর কথা উল্লেখ করব। তবে চন্দনা নদীর প্রবাহ পথ খুজেঁ পাওয়াটা বেশ কঠিন কাজ ছিল। এর কারণ হল চন্দনা এখন সম্পূর্ণভাবে মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। আর অনেক ছোট নদী আর খাল এসে চন্দনাতে মিশেছে। তাই এর প্রবাহ পথ পাওয়া সত্যিই দুষ্কর ছিল। ২০১৭ সাল থেকে এই নদীর প্রবাহ পথ নিয়ে আমরা কাজ চালিয়ে গেছি।
আরো পড়ুনঃ চারঘাট-বাঘার হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীঃ পার্ট-১
চন্দনা (রাজশাহী) নদীঃ
উৎসঃ গঙ্গা নদী
মোহনাঃ খালিশাডিঙ্গি নদী
চন্দনা নদী চারঘাটের একটি প্রাচীন মৃত নদী। চারঘাটের চন্দন শহর নামক মৌজা/গ্রাম থেকে চন্দনা নদীর উৎপত্তি। চন্দন শহর থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে বলে এই নদীর নাম হয়েছে চন্দনা। কথিত আছে যে কোন এক ব্রাহ্মণ ব্যবসায়ীর নামে চন্দন শহরের নাম করণ হয়েছে। তবে চন্দনা পূর্ণাঙ্গ একটি শাখা নদীতে পরিণত হওয়ার পূর্বে এটি একটি খাল ছিল বলে অনুমান করা যায়। যায় হোক, চন্দনার উৎস মুখ অনেক আগেই পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। মূল চন্দন শহর মৌজার প্রায় সবটুকুই পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। পরে পদ্মায় যে চর জেগেছে সেগুলা ভারতের অংশে পড়েছে।
|
ঠিক এই স্থান দিয়ে চন্দনা পদ্মা থেকে বের হত |
|
পদ্মার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের এই স্থান দিয়ে চন্দনা এক সময় বের হত। |
পদ্মা তার অবস্থান পরিবর্তন করে ক্রমশ পূর্বে সরে আসতে থাকলে চন্দন শহর বিলীন হয়ে যায়। সাথে চন্দনার উৎস মুখও পূর্বে সরে আসতে থাকে। পদ্মাকে আটকানোর জন্য নির্মিত দুইটি মাটির বাধঁ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ৩য় বাধঁটি আছে।
যে স্থান দিয়ে চন্দনা বের হত সেটি এখন
“ডিঙ্গাডোবা” নামে পরিচিত। এই
ডিঙ্গাডোবা নামের পেছনে দারুণ এক কাহিনী আছে। কথিত আছে যে “ শর্মা রাজা” নামের এক জমিদার শ্রেণীর লোক এই স্থান দিয়ে
গঙ্গা যাত্রার সময় প্রবল ঝড়ে এখানে তাঁর নৌকা ডুবি হয় এবং তাঁর শরীর সমাধি হয়। আরো কথিত আছে যে তিনি সোনার নৌকাতে করে প্রচুর ধন-সম্পদ সাথে নিয়ে পালাচ্ছিলেন। আর পালানোর সময় তাঁর সোনার নৌকা সহ নৌকা ভর্তি ধন-সম্পদ চন্দনা নদীর গর্ভে হারিয়ে যায়। তারপর থেকেই এক নাম করণ করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মাটি খুড়ঁলে বেরিয়ে আসবে শর্মা রাজার সেই অমূল্য সোনার নৌকা! তবে এই কাজটা এতটা সহজ না, কারণ শর্মা রাজার সেই সোনার নৌকা পাহাড়া দিচ্ছে পাতালবাসী জ্বিনের দল! যায় হোক শর্মা রাজার কাহিনী পরে আলোচনা করা হবে।উৎস মুখ থেকে সোজা পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ‘চ্যাঙ্গমারীর’ বিলের ভেতর দিয়ে চন্দনা প্রবাহিত হতে থাকে। এই চ্যাঙ্গমারীর বিল চন্দনা নদীর মৃত খাত ছাড়া কিছু না। এই স্থানে নদীর কোন চিহ্ন নাই। অনেক বাড়ি-ঘর আর বাগান নজরে আসে । তবে বিলে নিচু স্থান দেখে চন্দনার প্রাচীন প্রবাহ পথ অনুমান করা যায়। কিছুটা পূর্বে ডালিপাড়ার পেছনে এখনো কিছুটা নিচু স্থান আছে, যা নদীর প্রবাহ পথকে সমর্থন করে। সেখানে বাঁশ বাগানের কাছে একটি খেয়া ঘাট আছে। ডালিপাড়াকে পেছনে রেখে চন্দনা আরো কিছুটা পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ঘোষের মোড়ের কাছে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে ঘুরে গেছে। এই স্থানে নদী বা খালের বা বিলের কোন অস্তিত্ব প্রমাণ করা দূরহ কাজ। এখানে বড় বড় আম বাগান, বাড়ি, দোকান ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। শুধু একটা ছোট চুঙ্গা নদীর প্রবাহ পথ খুঁজতে আমাদের সহায়তা করে। এখান থেকে চন্দনা দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ‘পাতির বিলে’ প্রবেশ করে। এই বিশাল পাতির বিল চন্দনা নদীর মৃত খাত। বিশাল এই বিল দেখে চন্দনার প্রাচীন রূপের কিছুটা অনুমান করা যায়। পাতির বিল পার হয়ে চন্দনা প্রবেশ করেছে ‘কাঁকড়ামারির বিল’ এলাকায়। এই বিশাল কাঁকড়ামারির বিলও চন্দনা নদীর মৃত খাত বটে। এখানে চন্দনা নদী দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর, চারঘাট-বাঘা রোডের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
|
কাঁকড়ামারীর ব্রিজ থেকে তোলা চন্দনা নদীর মৃত খাত। ব্রিজের নিচে বৃষ্টির সামান্য পানি জমেছে, আর সেখানে জন্মেছে প্রচুর দেশি মাছ। বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে শ্রাবণ মাসেও এ’বছর বিলে পানি জমেনি। |
কাঁকড়ামারীর বিল চারঘাটের অত্যন্ত বিখ্যাত ও সবচেয়ে বড় বিল বলে বিখ্যাত। এই বিল শত শত বছর ধরে চন্দনা নদী তৈরি করেছে। এখানে পূর্বে বড় বড় কাঁকড়া পাওয়া যেত বলে নাম কাঁকড়ামারী। কাঁকড়ামারীর বিল জীব বৈচিত্রে ভরপুর একটা বিল। এখানে আগে বছরের বেশ কয়েক মাস পানি জমে থাকত। সেই পানিতে ছোট-বড় মাছ ও জলজ প্রাণী জন্মাত। এই বিল ছিল জলজ পাখিদের পছন্দের স্থান। বছরের বেশির ভাগ সময় বিলের কিছু স্থানে পানি জমে থাকত, আর সেই পানিতে জলজ পাখিরা খাদ্য স ংগ্রহ করত। তবে এখন ব্যাপক হারে পুকুর খনন করায় বিলের প্রাকৃতিক পরিবেশ আর নাই। ২০১৭ সালে অতি বৃষ্টির পর কাঁকড়ামারীর বিলে জলাবদ্ধতা দেখা দিলে চন্দনা নদীর কিছু পুন:খনন করা হলে এখন সেখানে বছরের বেশ কয়েকমাস পানি থাকে। সেই পানিতে শাপলা সহ বেশ কিছু জলজ উদ্ভিদ জন্মে। উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় জলল পাখি আর প্রাণীদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে চন্দনা নদী।
এরপর কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরে চন্দনা পূর্বে বাঁক নিয়ে চারঘাট-বাঘা মহাসড়কের (রাজশাহী-ঈশ্বরদী মহাসড়ক) নিচ দিয়ে সোজা পূর্বমুখী হয়ে চোকার বিলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মহাসড়কের নিচে যে দুইটি বড় বড় কালভার্ট আছে, সেগুলা আসলে চন্দনার প্রবাহ পথ নির্দেশ করে। এসব অঞ্চলে যে বিশাল বিল এলাকা দেখা যায়, সেগুলা মূলত চন্দনার তৈরি। এরপর চন্দনা সোজা পূর্বে অগ্রসর হয়ে চোকার বিল, পরানপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। চোকার বিলের কাছে চন্দনা প্রবাহ পথ এখন খালি চোখে বোঝা যায়। এখানে বড় বড় কয়েকটি দিঘী খনন করা হয়েছে, যা নাকি পূর্বে চন্দনার গর্ভে দহ আকারে ছিল। বর্ষা কালে এই বিলের রূপ চন্দনার প্রবাহ পথকে মনে করিয়ে দেয়। এখানেই আছে সেই বিখ্যাত শর্মা রাজার বাড়ি। রাজবাড়ির অনেক স্থান এখনো চোখে পড়বে। মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে রাজবাড়ি, মন্দির সহ আরো অনেক স্থাপনা। মল পুকুর, মন্দির আর রাজবাড়ির কিছু অংশ এখনো নজরে আসে। রাজবাড়ির চারিদিকে পরিখা খনন করে রাজবাড়ির সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন শর্মা রাজা। একটি খালের মাধ্যমে পরিখা গুলা চন্দনা নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। অত্যন্ত প্রতাপশালী এই জমিদারের পতন হয় তাঁরই এক ব্রহ্মণ দীক্ষা গুরুর অভিষাপে। শর্মা রাজার আরো অনেক কাহিনি আছে, তবে এখানে সেটি আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। নিচে শর্মা রাজার কাহিনির লিংক দেওয়া থাকবে; সেখান থেকে পড়ে নিতে পারবেন।
যায় হোক এখান থেকে চন্দনা পরানপুরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্বে বাঁক নিয়ে তালবাড়িয়া এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর আবার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে চন্দনা বড়বড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করে। এই সমস্ত এলাকায় চন্দনার কোন অবস্থান বর্তমানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এই সমস্ত গ্রামে এসে চন্দনা বিলের রূপ ঝেড়ে ফেলে ছোট খালের রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু সেই খালের অস্তিত্ব এখন প্রায় বিলীন হতে চলেছে। উল্লেখ থাকে যে চন্দনার সেই শীর্ণকায় খাত দিয়েই এই অঞ্চলের বর্ষার পানি প্রবাহিত হত। তবে খালের মুখ বন্ধ আর খাল দখল করে পুকুর খননের কারণে এখন আর বর্ষার পানি নিষ্কাশিত হতে পারছে না। এই অঞ্চলে “কেষ্ট ঠাকুরের” পুকুর নামের একটি বিখ্যাত পুকুর আছে। শোনা যায় যে চন্দনা নদীর তার গতি হারালে চন্দনার মৃত খাতে একটি বড় দহ দেখা যায়। পরে চন্দনা নদীর সেই দহকে দখণ করে একটি বিখ্যাত পুকুর খনন করেন জৈনক কেষ্ট ঠাকুর নামের এক ব্রাহ্মণ। শোনা যায় এই পুকুর খননে তিনি জ্বীনদের সহায়তা নেন! এই পুকুরকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আরো জানা যায় যে, চন্দনার গর্ভের সেই দহের পানি কখনও শুকিয়ে যেত না। শীত কালেও ঠিক পরিপূর্ণ থাকত সেই দহ। এই গ্রামের মানুষ এখনো চন্দনার কথা স্মরণে রেখেছে। তারা এই নদী নিয়ে আফসোস করে।
তালবাড়িয়া ও বড়বড়িয়া এলাকায় চন্দনার তৈরি করা বিলে আগে শীতকালে হাজার হাজার পাখির আগমন ঘটত। চখা-চখি, ঝিল্লি, কালোপাখ ঠেঙ্গ সহ আরো অনেক পাখি আসত। আর বিলে পানি ও খাবার থাকার কারণে দেশি পাখি, যেমনঃ সরালি পাখি, শামুকখোল, ডাহুক, ছোট-বড়-মাঝারি বগা, গো-বক, কাদা খোঁচা, খঞ্জনা, ডুবুরি, মাছরাঙ্গা, পানকৌরি সহ আরো অনেক পাখির আগমন হত। সচেতনার অভাবে এখানকার মানুষ প্রতি বছর পাখি শিকার করত। এখন পাখির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। প্রাকৃতিক জলাশয় গুলি রক্ষা করতে পারলে এখনো পরিযায়ী পাখি রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বড়বড়িয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বাঁক নিয়ে চন্দনা মনোহরপুর, বলিহার হাট গ্রামে প্রবেশ করে। আর এভাবেই চন্দনা চারঘাট উপজেলা পার হয়ে বাঘা উপজেলায় প্রবেশ করে। এসব অঞ্চলে বিশাল বিশাল বিল চন্দনার গতিপথ নির্দে শ করে। বলিহারের শেষ প্রান্তে এসে চন্দনা পূর্বে বাঁক নিয়ে হরিণা আর আড়পাড়ার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। বলিহার গ্রামে প্রবেশের মুখে চন্দনা নদীর একটি ত্রি-মোহনা আছে। তুলসিপুর ব্রিজের কাছে চন্দনা মিলিত হয়েছে বড়ালের শাখা গঙ্গামতি নদী ও মনিগ্রাম থেকে আগত মরা গাঙ্গ নদীর একটি শাখা। এই তিন নদীর মিলিত স্থানটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও এখনো বেশ গভীর। গঙ্গামতি আর মরা গাঙ্গ নদীর পুরোটাই এখন ব্যক্তি মালিকানায় পরিণত হয়েছে। কেউবা লিজ নিয়েছে, কেউবা দলিল করে নিয়েছে আবার কেউবা এমনি দখল করে খাচ্ছে।
|
তুলসিপুর ব্রিজ থেকে তিন নদীর মোহনার ছবি তুলছে লেখক
|
তুলসিপুরের উজানে
গঙ্গামতি আর মরা গাঙ্গ নদীর পুরোটাই পুকুর হয়ে যাওয়ার কারণে তুলসিপুরে আর বড়াল ও পদ্মার পানি আসে না। অথচ মাত্র দুই দশক আগেও ভরা বর্ষায় গঙ্গামতি দিয়ে বড়াল আর মরা গাঙ্গ দিয়ে পদ্মার পানি আসত। এক বয়স্ক ব্যক্তি আমাদের জানালেন যে আগে বার্ষাকালে এখানে এত তীব্র স্রোত হত যে দক্ষ সাতাঁর জানা লোকও সেখানে স্থির থাকতে পারত না! চারঘাট স্লুইচ গেটের চাইতেও বেশি স্রোত থাকত এখানে। বিল আর নদীর মাছে টৈ টম্বুর থাকত তুলসিপুর এলাকা। এগুলা এখন সবই অতীত। এখন আর উজান থেকে যেমন পানি আসতে পারে না, তেমনি পানি ভাটিতেও যেতে পারে না। মাত্র ৫/৬ বছর আগেও কাকড়ামারি থেকে তুলসিপুরে পানি আসত। আর সেই পানি নেমে যেত। তুলিসিপুরের কাছে সম্প্রতি একটা বড় বাঁধ দিয়ে মাদ্রাসার জন্য রাস্তা করা হয়েছে। যায় হোক তুলসিপুরে এখনো অনেক দেশি মাছ পাওয়া যায়।তুলসিপুরের নিচ দিয়ে তিন নদীর মিলিত প্রবাহ চন্দনা নাম ধারণ করে সামান্য দক্ষিণ-পূর্বে বাঁক নিয়ে বলিহার গ্রামে প্রবেশ করে। এরপর চন্দনা আরো বাঁক নিয়ে আড়পাড়ার দিকে চলে গেছে। আড়পাড়া থেকে এবার উত্তর-পূর্বে বাঁক নিয়ে নিশ্চিন্তপুরের দিকে চলে গেছে। এই নিশিন্তপুর-কামারপাড়া এলাকায় চন্দনা গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহ মরা গঙ্গা নদী বা মরা গাঙ্গ নদীর সাথে মিশেছে। মোহনার স্থানটি এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি তবে কামারপাড়া নামের বিশাল বিলেই যে দুই নদীর মোহনা ছিল এটা নিশ্চিত। পূর্বে চন্দনা কামারপাড়া বিল এলাকায় এসে তার যাত্রা শেষ করে গঙ্গার সাথে মিশে যেত। গঙ্গার এই প্রবাহটি এক সময় গঙ্গার মূল প্রবাহ তথা চলন বিলগামী প্রবাহ ছিল বলে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী মত দেন। পরে শাখা নদীতে পরিণত হলে মরা গঙ্গা নদী বলে এটিকে ডাকা হত। তখন চন্দনা এই নদীর একটা উপনদী ছিল মাত্র। এরপর মরা গঙ্গা নদী প্রাকৃতিক কারণে মজে গেলে চন্দনা বেগবতি হয়। তখন চন্দনা মরা গঙ্গা নদীর গতিপথ ধরে আরো অগ্রসর হতে থাকে। বিশাল কামারপাড়া বিল মরা গঙ্গা ও চন্দনা নদীর সৃষ্ট বিল। বিলের পাশের গ্রামের মানুষজন এখনো এই নদী পথকে সমীহ করে! তারা জানে যে এই নদী পদ্মার শাখা আর এই নদী বাঘাবাড়িতে যেয়ে প্রমত্তা বড়ালে মিশেছে। সবই ঠিক আছে, শুধু নদীর প্রবাহটা ঠিক নাই। এই কামারপাড়া বিলে এখন সারা বছর পানি জমে থাকে। বর্ষাকালে এই বিলে অথৈ পানি থাকে। বাঘা-পুঠিয়া সড়ক দিয়ে গেলে এই বিলের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। আগে বর্ষাার শেষে পানি নেমে গেলে কৃষকরা বোরো ধানের আবাদ করত। কিন্তু এখন ফসলি জমি পুরোটাই পানির নিচে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত চন্দনার অন্যান্য অংশের ন্যায় এখানেও পুকুর খনন করা হবে। কামারপাড়া বিল জীব বৈচিত্রে ভরপুর একটা বিল। এখানে এখন বছরের বেশিরভাগ সময় পানি আটকে থাকায় সারা বছর দেশি ও পরিযায়ী জলজ পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে চন্দনার মৃত খাত। আর এখানে দেশি মাছের প্রাচুর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
চন্দনা এরপর সোজা পূর্বে বাঁক নিয়েছে। আরো পূর্বে প্রবাহিত হয়ে নওটিকা গ্রামে প্রবেশ করেছে। এরপর নওটিকা গ্রামকে পেছনে রেখে চন্দনা নাটোর জেলার লালপুর উপজেলায় প্রবেশ করে মোল্লা পাড়ার পশ্চিম দিক দিয়ে বিলের আকারে পূর্বে প্রবাহিত হতে থাকে। এখানে চন্দনাকে ধন্দহ বিল বলে ডাকা হয়। বিলের অনেক স্থানে এখন পুকুর কাঁটা হয়েছে। এরপর চন্দনা উত্তর-পূর্বে অগ্রসর হয়ে রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেরার ধন্দহ গ্রামে প্রবেশ করে। এরপর চন্দনা আরো পূর্বে প্রবাহিত হয়ে বিলের আকারে অমরপুর গ্রামে প্রবেশ করে। এখানে বিলের মাঝে পুকুর কাটার হিড়িক পেড়েছে। চন্দনার সামান্য প্রবাহ পথ এখনো ধন্দহ গ্রামে বিলের আকারে রয়ে গেছে। বাকিটা সব পুকুর। এই স্থানে চন্দনা নদীতে/ধন্দহ বিলে সামান্য মাটি কাটলেই বালু পাওয়া যায়। অনেক লোক দুই-তিন ফিট মাটি খুঁড়ে নির্মাণ কাজের জন্য উন্নত মানের বালু উত্তোলন করে থাকে। বিলের এই বালুই প্রমাণ করে যে মাত্র কয়েক বছর আগেও এই বিলে পদ্মার বালু সমৃদ্ধ পানি প্রবেশ করত! স্থানীয়রা জানান যে বছর ৫/৬ আগেও কাকরামাড়ি এলাকা থেকে বর্ষায় পানি আসত। এখন সর্বত্র পুকুর কেটে প্রবাহ পথ বন্ধ হওয়ার কারণে পানি আসতে পারে না।
|
চারিদিকে পুকুর। মাঝের কিছু অংশ এখনো নদীর আকার ধারণ করে চন্দনার প্রাচীন প্রবাহের জানান দিচ্ছে। ছবিটা ধন্দহ গ্রামের। |
|
ধন্দহ এলাকায় চন্দনা বিলের আকারে প্রবাহিত হয়ে অমরপুরের দিকে চলে গেছে। এই স্থানে মাত্র ১/২ ফিট মাটি খুঁড়লেই উন্নত মানের বালু উঠে। আর পানি সেচ দেওয়ার সময় বালু থাকেই। |
ধন্দহ গ্রামের পূর্বে অমরপুর গ্রাম। বিলের আকার ধারণ করে চন্দনা অমরপুর গ্রামে প্রবেশ করেছে। এরপর আরো পূর্বে প্রবাহিত হয়ে চকবোয়ালিয়া গ্রামে এসে পদ্মার শাখা “
খালিসাডিঙ্গি” নদীর সাথে মিশেছে। যে স্থানে চন্দনা খালিসাডিঙ্গি নদীর সাথে মিশেছে সেটি রাজশাহী জেলার শেষ সীমানা। এরপর থেকেই লালপুর থানা তথা নাটোর জেলা শুরু। মোহনার স্থলে চন্দনা বোয়লিয়াপাড়া বিল নামে পরিচিত। চন্দনার পতিত স্থানে মাছ ব্যবসায়ীরা বাঁধ দেওয়ার কারণে বোয়ালিয়া পাড়া গ্রামে এখন জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার তিন ফসলি জমি এখন এক ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। চন্দনার পানি এখন আর খালিসাডিঙ্গি নদীতে নামতে পারছে না। শুধু যখন প্রবল বৃষ্টি হয়, কেবল তখনই বাঁধ উপচে খালিসাডিঙ্গিতে পড়ে। মজার বিষয় হল এই স্থানে খালিসাডিঙ্গি নদীর অবস্থা বেশ ভাল তবে নদীকে আবদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে মাছের চাষ হচ্ছে। আর খালিসাডিঙ্গি নদীকে এখানে সবাই চন্দনা বলে ডাকে। ফলে কেউ সহসা যেয়ে কোনটা চন্দনা আর কোনটা খালিসাডিঙ্গি বুঝতেই পারবে না। আসলে খালিসাডিঙ্গি নদীকে চন্দনা বলে ডাকার বিশেষ একটা কারণ আছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এই স্থান পরিদর্শন করে চন্দনার বেহাল দশা দেখে চন্দনা আর খালিসাডিঙ্গি নদীর ৩ কিঃমিঃ খনন করেন। খননের পর ঐ এলাকার চন্দনা আবার সচল হয়। তারপর থেকেই স্থানীয়রা এই নদীকে চন্দনা বলে ডাকতে থাকে। |
মোহনায় এসে খালিসাডিঙ্গিতে মিশছে চন্দনা নদী। মোহনার মুখে মাটির বাঁধ দেওয়া। অমরপুর বোয়ালিয়া পাড়া বিল এলাকা। |
|
বিলের আকারে খালিসাডিঙ্গিতে মিশে যাচ্ছে চন্দনা। শীতেও বিলে হাটুঁ সমান পানি। অমরপুর বোয়ালিয়াপাড়া বিল এলাকা থেকে তোলা ছবি।
|
২০১৭ সালে ভারী বর্ষার কারণে কাকরামাড়ি বিল এলাকায় প্রবল জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে পিরোজপুর এলাকা থেকে কাকরামাড়ি পর্যন্ত একটি খাল পুনঃখনন করে পদ্মার সাথে সংযুক্ত করা হয়। অনেকেই আবার এটিকে চন্দনার উৎস মুখ ভেবে ভুল করে থাকেন। আসলে এটি একটি খাল মাত্র যা চন্দনা আর পদ্মাকে সংযুক্ত করেছে।
চন্দনার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পুরোটাই একটি মৃত প্রবাহ। শুধু বিল ও কতক স্থানে খালের আকারে প্রাচীন নদীর প্রবাহ পথ চেনা যায়। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেব বা ং লার যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, সেখানে চন্দনার কোন ম্যাপ ছিল না। ফলে ধারণা করা যায় যে চন্দনা তখন ছোট নদী অথবা খালের আকারে ছিল বলে মানচিত্রে স্থান পায়নি। আরো একটি ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা চন্দনার বয়স নির্ণয় করা সম্ভব। প্রায় ২৫০ বছর আগে চন্দন শহরের গোড়া পত্তন। চন্দন নামের এক ব্রাহ্মণের নামে এই গ্রামের নামকরণ করা হয়। আর চন্দন শহর থেকে বের হয়েছে বলেই নদীর নাম হয়েছে চন্দনা। এদিকে ১৭৮৭ সালে মহা প্লাবন আর ভুমিকম্পের কারণে তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন ঘটে । তিস্তার েএই পরিবর্তন ব্রহ্মপুত্র, করোতয়া আত্রাই, পূণর্ভবা, পদ্মা সহ আরো অনেক নদীর গতিপথে পরিবর্তন এনেছিল। গঙ্গার একটি প্রাচীন ধারা মরা গঙ্গা নদী মূল গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ক্রমেই চন্দন শহরের নিকট পদ্মার একটি ছোট খাল হটাৎ প্রবাহ পেয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শাখা নদীতে পরিণত হয়। তখন স্থানীয়রা এর নাম দেন চন্দনা নদী। প্রায় ২০০ বছর পদ্মার বিশাল জলরাশি বহন করে চলন বিলে নিয়ে যেত চন্দনা। চারঘাট ও বাঘার অসংখ্য ছোট নদী, খাল ও বিলের সাথে সংযুক্ত ছিল চন্দনা। ফলে এটি চারঘাটের দক্ষিণ-পূর্ব ও বাঘার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ছিল। সে সময় চন্দনা ও খালিসাডিঙ্গি মিলিত প্রবাহ চন্দনা নামেই প্রবাহিত হত কারণ নদী হিসেবে চন্দনা ছিল অনেক বড় েএকটা নদী। ফলে চলন বিল এলাকায়ও এই নদী চন্দনা নামে পরিচিত ছিল। চন্দনা মরা গঙ্গা নদীর প্রবাহ পথ ধরে চলন বিলে চলে যেত। এক সময় বড় বড় নৌকা চলন বিলের মাঝ দিয়ে এই নদীতে এসে মিশত। ১৮৯৭ সালে এক প্রলয়ঙ্গকারী ভূমিকম্পে চন্দনার উৎম মুখে পলি পড়ে উৎস মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে নদী ছোট হয়ে যেতে থাকে। নৌ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। চন্দনা নদীর বিশাল খাত সব বিলে পরিণত হতে থাকে। ফলে এসব বিল আস্তে আস্তে ফসলি জমিতে পরিণত হতে থাকে। তবে ভরা বর্ষায় পদ্মা থেকে কিছু পরিমাণ পানি চন্দনা দিয়ে প্রবাহিত হত। আর তাই সিএস রেকর্ডে এখনো চন্দনার প্রবাহ পথ বর্তমান। চন্দনা সব শেষ নদীর বৈশিষ্ট্য ফিরে পায় ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছরে। সে বছর প্রবল বর্ষণে ও বন্যায় পদ্মা থেকে বিপুল জলরাশি এই পথে প্রবাহিত হতে থাকে। এই পথ দিয়ে অনেক লোক প্রত্যন্ত বিল অঞ্চলে যেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আবার অনেক মুক্তিযোদ্ধা চন্দনা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে পদ্মায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দেওয়ার ফলে চন্দনার উৎস মুখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে বড়ালের মাধ্যমে অনেক ছোট নদী ও খালের মাধ্যমে চন্দনা ছোট খালের আকারে বয়ে যেত। বিশেষ করে তুলসিপুরের পর থেকে চন্দনার খাত বেশ সচল ছিল। ১৯৮৫ সালে বড়ালে স্লুইচ গেট দিলে বড়াল থেকে গঙ্গামতি নদীতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গঙ্গামতি নদী চন্দনাকে আর পদ্মার পানি সরবরাহ করতে পারত না। কিন্তু তখনও এই নদীর প্রবাহ পথ ঠিক ছিল বর্ষার পানিতে। বর্ষার পানিতে বছরের প্রায় ছয় মাস চন্দনা পরিপুষ্ট থাকত। আর পুরো চন্দনার প্রবাহ পথ বিল আকারে থাকলেও বর্ষায় পুরাদমে প্রবাহমান হয়ে যেত। তখন দেখলে এটিকে নদী বলেই মনে হত। কিন্তু ক্রমেই বিলে নানা স্থাপনা তৈরি হওয়ার কারণে চন্দনার পুরাতন খাতটিও বিলীন হতে থাকে। আসলে নদী যথন বিলে পরিণত হয়, তখন সেটি আস্তে আস্তে ব্যক্তি মালিকানায় পরিণত হতে থাকে। এটা অপরাধের কিছু না; আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিই পূর্বে কোন নদী খাত ছিল। তবে অপরাধ হল পানির প্রবাহকে নষ্ট করে দেওয়া। বিশেষ করে চন্দনার যে ছোট অংশটা সিএস রেকর্ডে খাল হিসেবে চিহ্নিত করা আছে, সেটাও দখল করে পানি প্রবাহ একেবারেই আটকে দেওয়া হয়েছে। কেউবা জাল দলিল করে, আবার কেউবা লিজের নামে খালের প্রবাহকে আটকে মাছ চাষ করছে। চন্দনার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে বিগত এক যুগ। এই সময় সিএস রেকর্ডে খাল হিসেবে চিহ্নিত চন্দনার অবশিষ্ট খাতে যে যেমন পেরেছে পুকুর খনন করেছে। ফলে এক যুগ আগেও চারঘাটের পানি নির্বিঘ্নে ধন্দহ এলাকায় পৌছাতে পারলেও এখন আর পারছে না। চন্দনার এই খাতটি দখল হয়ে যাওয়ার ফলে চারঘাট ও বাঘার বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এখন জলবদ্ধতা সমস্যায় ভুগছে। সরকারি দফ্তরের লোকজন মাঝে মাঝে এসে জরিপ করে যাচ্ছেন। কিছু অংশে হয়ত খনন করা হবে। তবে এই খননে কোন কাজ হবে না। খনন করলে সিএস রেকর্ড ধরে কাকরামাড়ি থেকে ধন্দহ-অমরপুর পর্যন্ত খনন করতে হবে। এতে এক দিকে যেমন জলবদ্ধতা দূর হবে তেমনি দেশীয় মাছের বিপ্লব ঘটে যাবে। আরো সম্ভব হলে চন্দন শহর থেকে খনন করে পদ্মার সাথে পুনঃসংযোগ করে বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে আবারো পদ্মার পানি লাভের ব্যবস্থা করা যায়। সেক্ষেত্রে উৎস মুখে একটি রেগুলেটার বসাতে হবে।
আমরা যখন চন্দনা নদী নিয়ে কথা বলছি তখন চন্দনা নামে প্রবাহিত আরেকটা নদী নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। আড়ানী ঋষিপাড়ার কড়ইতলায় বড়াল নদী থেকে একটি শাখা নদীর জন্ম হয়েছে। স্থানীয়রা এই নদীকে চন্দনা নদী বলে ডেকে থাকে! একই নামের একাধিক নদী থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না। যেমন রাজবাড়ি জেলায়ও চন্দনা নামের নদী আছে। কিন্তু আড়ানী কয়েক বছর আগেও চারঘাট থানার অধীনে ছিল। ফলে একই থানার ভেতরে দুইটি নদী িএকই নামে প্রবাহিত হওয়ার ঘটনা অসম্ভবই বলা চলে। এই নদীপথের কিছু বর্ণনা আগে দেখে নেওয়া যাক।
|
বড়াল নদ থেকে জন্ম নিয়েছে চন্দনা নামে পরিচিত ছোট এই শাখা নদীটি। |
আড়ানী ঋষিপাড়ার বড়াল নদী থেকে ছোট একটা শাখা নদীর জন্ম। এই নদীর উৎস মুখে ১৯৯৮ সালের বন্যার পর একটা রেগুলেটর বসানো হয়। তারপর থেকে বড়ালের পানি আর এই নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। তবে বিলের পানি এই পথ ধরে বড়ালে পড়ে। নদীটি পুঠিয়া-বাঘা সড়কের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে বাঁক নেয়। এরপর পাঁচপাড়া এলাকা থেকে আগত বেশ কিছু প্রবাহের সাথে মিশে পূর্বে বাঁক নিয়ে তেঁতুলিয়া ফায়ার সার্ভিসের সামান্য আগে বাঘা-আড়ানী সড়কের নিচ দিয়ে খোর্দ বাউসা,
|
খোর্দ বাউসা এলাকায় পুরাতন চন্দনা নদীর মৃত খাত |
তৈরিপাড়া প্রভৃতি গ্রামে চলে যায়। এরপর আরো পূর্বে খগরবাড়িয়া পার হয়ে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে নদীটি দিঘা এলাকায় চলে আসে। এই স্থানে নদী খনন করা হয়েছে বলে নদীতে যথেষ্ট পানি আছে। আবার দেশীয় মাছও আছে। এরপর দিঘা পার হয়ে দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে নদীটি লালপুর উপজেলার সালামপুর ইউনিয়নে প্রবেশ করে। এরপর লক্ষণবাড়িয়া এলাকায় এসে নদীটি খালিসাডিঙ্গী নদীর সাথে মিলিত হয়। মোহনার কাছে খালিসাডিঙ্গির চেয়ে চন্দনার প্রবাহ বেশ ভাল আছে। স্থানীয়রা মিলিত প্রবাহকে চন্দনা বললেও সেটি আসলে খালিসাডিঙ্গি। সরকারি নথিতেও তাই আছে।
|
প্রবাহমান নদীটি পুরাতন চন্দনা আর শুকনা শীর্ণ |
কায় নদীটি হল
খালিসাডিঙ্গি। মোহনার কাছে খালিসাডিঙ্গি নদীর অস্তিত্ব নাই বললেই চলে। |
ডানের প্রবাহ পথটা পুরাতন চন্দনার খাত। আর বামের নদীটি খালিসাডিঙ্গি |
আসলে একই থানার ভেতরে প্রবাহিত দুইটি নদীর নাম এক হওয়ার কোনই কারণ নাই। আড়ানী এলাকার মানুষ এই নদীটিকে চন্দনা বলে ডাকে না। মূলত বাউসা এলাকার লোক নদীটিকে চন্দনা বলে ডাকে। এই নদীটিকে চন্দনা নামে ডাকার দুইটি কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি।
চন্দনা নদী কামারপাড়া বিল
এলাকায় মরা গঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চন্দনা নিজে একটি নতুন নদীপথ
তৈরি করে সালামপুরে এসে মূল মরা গঙ্গা নদীতে মিশেছে। কিন্তু মরা গঙ্গা নদীটি মজে যাওয়ার
পরে আড়পাড়া, পাঁচপাড়াগামী মরা গঙ্গা নদীটি চন্দনার কাছ থেকে প্রবাহ পাচ্ছে। এই মরা
গঙ্গা নদীর সাথে চারঘাটের পুটিমারি ও আড়ানীর কাছ থেকে আরেকটি বড়ালের শাখা নদী এসে মিশেছে।
মিলিত ধারা সালামপুরে যেয়ে চন্দনার সাথে মিশেছে। তাই হয়ত স্থানীয়রা কামারপাড়া থেকে
পাঁচপাড়াগামী ধারাটিকে চন্দনা হিসেবে ধরে এই নদীটিকে চন্দনা নদী বলে ডেকে থাকে। এটিই হল আসল কারণ।
প্রথমত, ১৭৮৭ সালের মহা প্লাবন আর ভুমিকম্পের পর মরা গঙ্গা নদীটি মজে যেতে থাকে আর চন্দনা বেগবতী হতে থাকে। চন্দনা নদী তখন মরা গঙ্গা নদীর প্রবাহ পথ অনুসরন করে লালপুর, বড়াইগ্রাম, চাটমোহর এলাকায় প্রবেশ করতে থাকে। তখন এই নদীকে স্থানভেদে চন্দনা অথবা মরা গঙ্গা/মরা গাঙ্গ বলে ডাকা হত। মূলত বড়াইগ্রাম আর চাটমোহর মরা গঙ্গা/ মরা গাঙ্গ নামটি প্রচলিত ছিল। আর বাঘা ও লালপুরে নদীটি চন্দনা নামে প্রচলিত ছিল। যদিও চন্দনা খালিসাডিঙ্গীর সাথে লালপুরে মিলিত হত, কিন্তু খালিসাডিঙ্গী চন্দনার তুলনায় ছোট নদী হওয়ায় এটিকে চন্দনার একটি উপনদী হিসেবেই গণ্য করা হত। এরপর ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে মরা গঙ্গার ন্যায় চন্দনার উৎস মুখে পলি পড়ে নদীটির উজানে মজে যায়। কিন্তু তখনও বড়াল নদী ছিল খরস্রোতা। ফলে বড়াল থেকে বিভিন্ন নদী ও খালের মাধ্যমে চন্দনা নদীর ভাটির দিকে নাব্য ছিল। আড়ানী থেকে যে ছোট নদীটি বের হয়েছিল সেটি মূলত চন্দনার প্রবাহকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল। হয়ত এই কারণে তখনকার লোকের এই ছোট নদীটির নাম চন্দনা রেখে মূল চন্দনার সাথে এক করে দিয়েছে। কারণ এটিই ছিল তখন চন্দনা (আসলে খালিসাডিঙ্গি) নদীর মূল প্রবাহ। আর এটি করার সময় স্থানীয়রা খালিসাডিঙ্গী নদীর বিষয়টা আমলেই নেয়নি, কারণ নদী হিসেবে তখন খালিসাডিঙ্গী চন্দনার চেয়ে ছোট ছিল। উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে চন্দনা বেগবতী ছিল আর এই নামেই লালপুর ও বড়াইগ্রামে সম্ভবত পরিচিত ছিল। পরে সিএস রেকর্ড করার সময় উজানে চন্দনা মজে যাওয়ার কারণে ভাটিতে চন্দনা আর খালিসাডিঙ্গী নদীর মিলিত ধারার নাম সরকারি কাগজে খালিসাডিঙ্গী হিসেবেই উঠে আসে। কারণ খালিসাডিঙ্গী তখন উজানে খুব বড় নদী না হলেও নাব্য নদী ছিল। আর অনেক ছোট ছোট নদী-খালকে এক করে চলন বিলের মাঝে তখন প্রবাহমান ছিল। এটিই হল আড়ানী থেকে জন্ম নেওয়া বড়ালের শাখা নদীর চন্দনা বলে ডাকার সম্ভবত কারণ। এই যুক্তিটাকেই বেশি প্রহণযোগ্য বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়টি হল, মরাগাঙ্গ নদীর একটি শাখা খাল আড়পাড়া এলাকা থেকে জন্ম নিয়ে পাঁচপাড়ার দিকে চলে গেছে। পাঁচপাড়ায় গিয়ে সেটা চারঘাট থেকে আসা আরেকটি শাখা নদীকে সাথে নিয়ে পরে আড়ানী থেকে বেরিয়ে আসা শাখাটিকে সাথে নিয়ে নানান পথ পাড়ি দিয়ে আবার দিঘা এলাকায় এসে মরা গাঙ্গ নদীতে মিশত। যেহেতু চন্দনা মরাগাঙ্গ নদীর পথ অনুসরণ করে চলছিল, তাই মরাগাঙ্গ নদীর সেই শাখা খালও তখন চন্দনার শাখা নদীতে পরিণত হয়েছিল। ফলে সেখানকার মানুষ এই বড়ালের শাখা নদীটিকে চন্দনা বলে ডাকতে শুরু করে।
আরেকটি কারণ এমন হতে পারে যে চন্দনা ১৭৮৭ সালের আগে আড়পাড়া হয়ে পাঁচপাড়া, আড়ানী দিঘা হয়ে সালামপুরে মরাগাঙ্গ নদীতে মিশত। পরে ১৭৮৭ সালের পর চন্দনা মরাগাঙ্গ নদীর প্রবাহ পথ অনুসরণ করতে থাকলে আগের আড়ানী গামী খাতটি পরিত্যক্ত হয়। তবে মানুষের মুখে মুখে তখনও চন্দনা নাম রয়ে যায়। তবে প্রথম দুইটি মতবাদ সত্যি হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তথ্যপুঞ্জিঃ
মাহবুব সিদ্দিকী-নদী গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ঝিকড়া নিবাসী মোঃ মেহেদি হাসান। যার সাহায্য না পেলে প্রত্যন্ত অঞলে গবেষণা করা সম্ভব ছিল না। আরো ধন্যবাদ জানাচ্ছি মোঃ আবু সাঈদ অন্তরকে। আর নাম না জানা সে সকল ব্যক্তিদের, যারা তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন
লেখকঃ
মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি
এলাকায় গিয়ে এরকম কাজ গুলো খুবই ভালো লাগে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ভাই
অভি ভাই আমিও ছিলাম।
উত্তরমুছুন