চারঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/আদিবাসী সম্প্রদায়
নব পলল দ্বারা গঠিত রাজশাহীর চারঘাটের বেশির ভাগ মাটি। হিন্দু-মুসলমানদের পাশাপাশি কিছু সাঁওতাল-পাহাড়িয়ার বাস আমাদের চারঘাটে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বাংলার বেশ কিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস। চারঘাটের সাঁওতাল-পাহাড়িয়া-তুরিরা কবে থেকে চারঘাট অঞ্চলে বসবাস করছেন, তার সঠিক কোন ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন। তাঁদের আদি নিবাস বরেন্দ্র অঞ্চলে নাকি ভারতের বিহার রাজ্য থেকে তাঁরা এসেছেন, তার হিসার মেলাও দায়। চারঘাটে সব মিলিয়ে ৮৫২ জনের মত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকের বাস (২০১৮).
চারঘাট, নিমপাড়া ও শলুয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে তাঁদের বাস। নিজেদের আত্নপরিচয় ভুলে এখন তাঁরা হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। চারঘাট উপজেলায় মোট ২৩২ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী পরিবার আছে। চারঘাট ইউনিয়নের পরানপুর আর হ্যারিনি পাড়ায় থাকেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কিছু পরিবার। পরানপুরে মোট ২৭ ঘর সাঁওতালের বাস। নিজেদের সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা। হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীই তাঁদের উপাস্য। নিজস্ব ভাষার কোন প্রচলন নেই, নেই কোন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। অন্যের জমিতে তাঁদের বাস। মাত্র তিনটি পরিবারের নিজস্ব জমি আছে। পাড়ার প্রধান, বাবু রাম মল্লিক। তিনি পেশায় ভ্যান চালক। পুরো পাড়া মিলে একটা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীর সন্ধান মিলেছে। আর স্কুল পড়ুয়া আছেন কয়েকজন। হ্যাড়িনি পাড়ার চিত্রটা একই বলা চলে। মোট ২০ টি পরিবারের বাস এখানে। চারঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব ফজলুল হকের ভাই মজিবুর মাস্টারের জমিতে তাঁরা বসবাস করছেন। শিক্ষার হার এখানেও হতাশা ব্যাঞ্জক। 'রনো' নামের একটা ছেলে রাজশাহী কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে (২০১৭)। আর স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আছে। রনো এখন পাড়ার মধ্যমনি। আমরা আসার পর তাঁর সাথে কথা হয়। এখানে না আসলে বোঝার উপায় ছিল না, শিক্ষার আলো এখানে কতটা অধরা! আঁট-সাঁট করে তৈরি করা হয়েছে সাঁওতালদের বাড়ি গুলি। নিজের জমি নাই, অন্যের জমিতে কাজ করছেন তাঁরা। কেউ আবার বর্গা নিচ্ছেন। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁদের অনেক জমি ছিল বলে জানা যায়। যুদ্ধের সময় ও তারপরে অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছেন। হ্যাড়িনি পাড়ার লোকেরা শুধু শিব পূজা করেন। এখানকার সাঁওতালরা এখনো প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান। তাঁরা না পেরেছেন নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে, না পেরেছেন অন্যদের সাথে মিশে যেতে।
শলুয়ার ঘোষপাড়ার (চকগোচর) চিত্র অবশ্য আলাদা। এখানকার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক নিজেদের সাঁওতাল বলে পরিচয় পর্যন্ত দেয়নি। তাঁরা নিজেদের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মিশিয়ে ফেলেছেন। দুই-এক জনের চেহারার মাঝে সাঁওতালের ছাপ বোঝা যায়। বাকিদের দেখে সাঁওতাল বলে শনাক্ত করাও দায়।
আসলে বহু পূর্বেই তাঁরা স্থানীয় হিন্দুদের সাথে মিশে গেছেন। নিজেরা এখন জমি কিনে বাড়ি করেছেন। এই পল্লীর ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে, পুরুষরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাহলে শুধু শুধু নিজেদের সাঁওতাল পরিচয় দিয়ে কি লাভ? তাঁরা নিজেদের মল্লিক পরিচয় দিয়েছেন। আগের দু'টি পল্লীর লোকের পরিচয়ও মল্লিক বটে। কটু মল্লিক/ নিত্য মল্লিক ঘোষপাড়ায় আদিবাসীদের প্রধান। সাঁওতালরা এখন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে বিয়ে করে। এখানে মোট ১৫ টি পরিবার আছে। বামনদিঘী বাজারের কাছে 'রাজশাহী সুগার মিলে'র অনেক আবাদি জমি আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানে ২৬ টি সাঁওতাল ও ১ টি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের বাস। তবে তাঁরাও নিজেদের সাঁওতাল বলে পরিচয় না দিয়ে কর্মকার বলে পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাদের শারীরিক গঠন বলে দিচ্ছে যে তাঁদের পূর্ব পুরুষরা অস্ট্রিক ভাষী প্রাক-অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়। এই পল্লীর অবস্থাও ভাল না; চারঘাট ইউনিয়নের সাঁওতাল পল্লীর ন্যায় করুণ জীবনপাত এখানে।
বামনদীঘি বাজার থেকে আর কিছু দূর গেলেই সরদার পাড়ায় দেখা মিলবে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের। উনারা দু'বছর আগে হরিষপুর মিশনারীদের কাছ থেকে খ্রিঃ ধর্মে দিক্ষীত হয়েছেন। এখানে মোট ৭-৮ টি পরিবার আছে। পেশায় তাঁরাও কৃষি শ্রমিক। গ্রাম প্রধান বৌদ্ধনাথ পাহাড়িয়া। তাঁর বাড়িতে প্রতি শুক্রবার উপসনার ব্যবস্থা করা হয়। নিজস্ব জমি বলতে বাড়ির ভিটে টুকুই আছে। আর বামনদিঘী বাজারের কাছে ধীরেন পাহাড়িয়া থাকেন সুগার মিলের শ্রমিকদের সাথে।
নিমপাড়া ইউনিয়নের কামনীগঙ্গারামপুর খ্রিস্টান পাড়ায় বাস করেন ১৩ ঘর পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোক। তাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন অনেক আগে। অস্ট্রেলীয় ট্রাস্টের মাধ্যমে তাঁরা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।তাঁদের অনেকেই এখন ছোট চাকরী করে থাকেন। এখানকান গ্রাম প্রধান ষষ্টি পাহাড়িয়া। তিনি চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সন্তান নন্দনগাছী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেছেন। এখন তিনি ঈশ্বরদী ইপিজেড-এ স্কয়ার কম্পানীতে চাকরী করে।
বাকি ৩০-৪০ জনের সবাই কৃষিকাজে নিয়োজিত।
আর ফকিরের মোড় দিয়ে বিজোড়ের বরকতপুর গ্রামে আছে আরো ২৫ টি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ঘর। এক বছর পূর্বে তাঁরা খ্রিস্টান হয়েছেন। তাঁরাও পেশায় কৃষিজীবি। সেখানকার গ্রাম প্রধান অজয় পাহাড়িয়া। উনার মা আমাদের 'মালতো' ভাষায় কথা বলে শুনান। এছাড়াও সরদহ ইউনিয়নের পাটিকান্দিতে আরো ৫টি পাহাড়িয়া পরিবারের বাস।
নিমপাড়া ইউনিয়নের কুঠিপাড়ায় আছে আরো ৩৬ টি 'তুরি' সম্প্রদায়ের বাস। এটি চারঘাটের সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লী। এটি পুরাতন নন্দনগাছী নামেও পরিচিত। এখানকার গ্রাম প্রধান হলেন সুকুমার। তিনি চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতির সভাপতি। তাঁরা প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে 'চৈত্র সংক্রান্তি'র পূজা ও মেলার আয়োজন করে থাকেন। চরক গাছের গুড়ির সাথে 'সন্ন্যাসী'রা উপরে ঝুলতে থাকে। তাঁদের পিঠে ফলা থাকে। এই পূজার অনেক নিয়ম-কানুন আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বড়াল পাড়ের এই মেলা ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় চৈত্র সংক্রান্তির মেলা!! মেলার আয়োজক কমিটির প্রধান হলেন 'ষষ্টী'। এই পাড়ায় মোট ১৩৭ জনের বাস। এছাড়াও সরদহ ইউনিয়নের বড়ালের ধারে গুচ্ছ গ্রামে ১২টি পরিবার, বনকিশোর গ্রামে ৩০টি পরিবার ও হটাৎ পাড়ায় ২৩টি ঋষি সম্প্রদায়ের পরিবার বসবাস করেন।
চারঘাটের পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের সবাই খ্রিস্টান। মূলত সুযোগ-সুবিধার জন্য তাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তাদের অবস্থা পরানপুর, হাড়িনি পাড়া ও নন্দা খামাড়ের শ্রমিকদের চেয়ে ভাল তবে, ঘোষপাড়ার সাঁওতালদের মত অতটা উন্নত না। নিম্নবর্ণের হিন্দুর সাথে মিশে যাবার কারণে সাঁওতাল-পাহাড়িয়া-তুরি সম্প্রদায়ের স্বভাব সুলভ শারীরিক কাঠামো লোপ পেয়েছে।
চারঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেদের পোশাক-পরিচ্ছদে এখন আর তেমন ভিন্নতা নাই। পুরুষরা লুঙ্গি পড়েন আর নারীরা পড়েন শাড়ি। বিবাহিত মেয়েরা হাতে শাঁখা ও মাথায় সিঁদুর পড়েন। এছাড়াও আর্থিক সঙ্গতি থাকলে সোনার গহনা ব্যবহার করেন। পুরুষরা গলায় মালা পড়েন। শিক্ষিত পুরুষরা এখন লুঙ্গির পাশাপাশি শার্ট-প্যান্ট পড়েন। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরাও সালোয়ার পড়ে থাকেন। তবে মোটা দাগে লুঙ্গি আর শাড়িই হল পোশাক।
খাবারের ক্ষেত্রে এখনো কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বেশির ভাগই অতি দরিদ্র হওয়ার কারণে তাঁরা সর্ব সাধারণের খাবারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবারের সন্ধান করে থাকেন। অনেক বুনো সবজি ও লতা-পাতা তাঁরা সন্ধান করে খান। আর মাংসের জন্য তাঁরা বিভিন্ন বন্য প্রাণী ও পাখির ওপর নির্ভর করে থাকেন। বিশেষ করে বুনো খরগোশ তাঁদের প্রিয় খাবার। এছাড়াও গন্ধগোকুল, বিড়াল, সাপ, ব্যাঙ, বুনো কবুতর ও ঘুঘু, বুনো কোয়েল, ক্ষেত্র বিশেষে ইদুর ইত্যাদি তাঁদের খাদ্য তালিকায় আছে। আর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা শূকর পালন করে তার মাংস খেয়ে থাকেন। সনাতন ধর্মের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও সুযোগ পেলে শূকরের মাংস খেয়ে থাকেন। বিশেষ দিনে তারা 'তাড়ি' (স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত মদ) পান করেন।
বেশিরভাগ আদিবাসীই সনাতন ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্মের সব দেবতা তাঁদের পূজ্য। হিন্দুদের ন্যায় তাঁরাও পূজা অর্চনা করে থাকেন। পূজা পরিচালনা করেন হিন্দু ব্রাহ্মণ শ্রেণীর পুরোহিতরা; যারা সাধারণত আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দা নয়। শিব তাঁদের জনপ্রিয় দেবতা আর চৈত্র সংক্রান্তি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের প্রধান উৎসব। তবে হিন্দুদের অন্য পূজা অর্চনাতেও তাঁরা অংশ নেন। উল্লেখ্য, উঁচু শ্রেণীর হিন্দুরা সচরাচর চৈত্র সংক্রান্তি পূজোয় অংশ নেন না। তবে নিচু বর্ণের হিন্দুরা খুব আগ্রহ নিয়ে অংশ নেন। পাহাড়িয়ারা আচার পালন করেন খ্রিস্টান রীতি মেনে। তবে তাঁদের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনেক প্রভাব থেকে গেছে।
ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, কোল, মুণ্ডা ইত্যাদি শ্রেণীর লোকদের পূর্ব পুরুষরা আর্যদের আগে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করেছেন কিংবা তাঁদের হাত ধরেই উপমহাদেশে মানব সভ্যতার শুরু। তাঁদের পূর্ব পুরুষরা প্রাক-অস্ট্রেলীয় বলে পরিচিত। তাঁরা এই ভূখণ্ডের আদি জাতি। তাঁদের সাথে কিরাত জাতি মিলে 'নিষাদ' জাতির উদ্ভব হয়েছিল। তাঁদের ভাষা ছিল 'অস্ট্রিক' তারা ছিল অরণ্যচারি, যাযাবর ও অসভ্য। কৃষিকাজ আর পাখি শিকারে তারা সিদ্ধহস্ত ছিল। পরে দ্রাবিড় জাতি এই অঞ্চলে এসে সভ্যতার শুরু করে। সিন্ধু সভ্যতা তাঁদেরই মহান কীর্তি। আর্যরা এদেশে আসলে দ্রাবিড়দের বিতাড়িত করে। নির্বাসিত দ্রাবিড়রা আশ্রয় নেয় সাঁওতালদের গৃহে। পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা দ্রাবিড়দের বংশধর। ভারত আর শ্রীলংকার তামিলরা দ্রাবিড়দের বংশধর। ভারতের বিহার রাজ্যে এদের বাস। জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন আর কৃষিকাজের জন্য বাংলার রাজা-জমিদাররা তাদের বিহার থেকে আনতেন। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশে থেকে গেছেন। উত্তরবঙ্গের অনেক জেলাতেই উপমহাদেশের এই আদিবাসীদের দেখা মেলে। রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক সাঁওতালের বাস। এসব অঞ্চলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সংগঠন আছে। দাবি আদায়ে তাঁরা স্বোচ্ছার; একতাবদ্ধ। তবে চারঘাটের অবস্থা ভিন্ন। তাঁদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। সাঁওতালেরা এখন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে মিশে গেছেন। লোপ পেয়েছে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে গেছে নিজস্ব সংস্কৃতি। শুধু পরাণপুর আর হাড়িনিপাড়ার সাঁওতালেরা চরখের মেলায় যান। সাঁওতাল কিংবা পাহাড়িয়া, কোন সম্প্রদায়ের মাঝেই এখন নিজস্ব ভাষা কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে আলাদা চেতনা কাজ করে না। সাঁওতাল আর তুরি সম্প্রদায়ের ভাষা এক। তারা 'সাদরী' ভাষায় কথা বলেন। আর ঋষিরা বলেন 'ঠার' ভাষায়, যা আজ বিলুপ্তির পথে। অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নাই। বিশুদ্ধ রক্তের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকের সংখ্যা কমে আসছে। অনেক স্থানেই নিম্নবর্ণের হিন্দুর সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকেরা মিলে গেছেন। দেশে বেশ কয়েক লক্ষ্য সাঁওতাল আছে। সাঁওতাল দেশের সর্ব বৃহৎ ক্ষুদ্র জাতি সত্তার গোষ্ঠী। তবে পাহাড়িয়া আছেন মাত্র ৭ হাজারের মত। সেদিক থেকে চারঘাটের পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অথচ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে তাঁদের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। অনেকেই তাঁদের নিজেদের ভাষা ভুলে গেছেন। চারঘাটের ঠোঁট মোটা, কোকড়ানো চুল, মিশমিশে কালো, তীরন্দাজ লোকেরা এখন আর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে না। কিছু পল্লীতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না (২০১৮)। তাঁদের দেখার যেন কেউ নেই। উপজেলা অফিসে ক্ষুদ্র কোন তথ্য নেই। 'সচেতন' নামের একটি সংগঠন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকেদেের নিয়ে কাজ করে বলে শুনেছি কামনীগঙ্গারামপুরে। তবে অন্যরা জানিয়েছেন যে তাদের কাছে কেউ আসে না। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত। আদিবাসী পল্লীতে বয়স্ক ব্যক্তির দেখা তেমন একটা নজরে আসেনি। বুঝতে পারছি তাদের গড় আয়ু বেশ কম। শিক্ষার দিগন্ত এখানে প্রসারিত না। সভ্যতার আড়ালে বসবাস করে চারঘাটের অন্ত্যজরা। অন্ত্যজ নামটাই বেশ মানাচ্ছে। এই সাঁওতাল আর পাহাড়িয়ারা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে এখানে এসেছেন নাকি তাঁরা আগে থেকেই এখানে ছিল, সেটা এখনো পরিস্কার না। ভুলে গেলে হবে না যে রাজশাহী অঞ্চল এক সময় 'পুণ্ড্র' জনপদের অংশ ছিল; আর সেটি প্রায় ২৫০০ বছরের ইতিহাস বহন করে চলেছে। আজকের বাংলাদেশ এক সময় অনার্যদের উর্বর ভূমি ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার লালন করে এসেছিল। এই কৃষি নির্ভর ব-দ্বীপের তারা ভূমিপুত্র। আর্যরা ভারতে প্রবেশ করলেও তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসেছে অনেক পরে। যখন এসেছে, তখন তারাও অনার্যদের সাথে মিশে এক মিশ্র জাতির উদ্ভব করেছে। যে 'অস্ট্রিক' জাতির কথা বলেছি, তারাই বর্তমান বাঙ্গালী বা বাংলাদেশীদের পূর্ব পুরুষ। ফলে সমতলের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীই যে আমাদের পূর্ব পুরুষ তা অস্বীকার করা যায় না। অথচ সেই জাতিসত্তার লোকেরা আজ সমাজের নিচু স্তরে ধুকে ধুকে সংগ্রাম করে চলেছে। তাদের অনেকেই আদিবাসীর তকমা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগুতে চলেছে। এই হল চারঘাটের অন্ত্যজদের অবস্থা।
অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোক এখনো সমাজের মূল ধারায় মিশতে পারেননি। রাজশাহীর চারঘাট থানার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লী গুলি তার বড় প্রমাণ। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের একটা সুন্দর জীবন প্রত্যাশা করতেই পারে। তাঁদের সমাজের মূল ধারায় আনতে হলে প্রথমেই তাঁদের রেশনিং-এর আওয়ার আনতে হবে। ভূমিহীন পরিবার গুলোকে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে মুজিব বর্ষে অনেক ভূমিহীন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিবার ঘর পেয়েছেন; বাকিদেরও ভূমি বরাদ্দ দিতে হবে। এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকেরা কৃষি কাজে দক্ষ হন। আর তাই তাদের সরকারি খাস কৃষি জমি বরাদ্দ দিল একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে তেমনি, তাঁরা তাঁদের নিজেদের খাদ্য চাহিদার অনেকটাই নিজেরা মেটাতে পারবেন। উপজেলার যেসব খাস জমি প্রভাবশালীরা দখল করে আছেন, তাঁদের কাছ থেকে আগে সেগুলা দখল মুক্ত করতে হবে।
এছাড়া তাঁদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য ও তাঁদের পুষ্টি মেটানোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকা বাদে অন্য যেকোন উপজেলার চাইতে চারঘাটের শিক্ষার হার অনেক বেশি। অথচ সমাজের একটা বড় অংশকে আমরা এখনো শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে পারিনি! করোনা বাস্তবতায় স্কুলগামী অনেক শিক্ষার্থী আবার পড়াশুনা ছেড়ে দিবে হয়ত। ফলে এসব পল্লীতে প্রচলিত বাল্য বিবাহ আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আরেকটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরর লোকেরা তাঁদের আমিষের চাহিদার জন্য এখনো অনেকাংশে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। পুরো দেশেই বন্য প্রাণী দ্রুত কমছে। আর চারঘাট বা এর আশেপাশের এলাকায় কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চলই নাই। এমন বাস্তবতায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা বন বিড়াল, বুনো খরগোশ, বাগডাস, গন্ধগোকুল, মেছো বাঘের মত মহা বিপন্ন প্রাণী শিকার করে আমিষের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। এছাড়াও শিয়াল, বিড়াল সহ অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও বন্য পাখি শিকার করছেন। সমতলের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী সম্প্রদায় এখনো শিকার করে আমিষের চাহিদা মেটান। কারণ বাজার থেকে মাছ বা মাংস কিনে খাওয়ার মত ক্রয় ক্ষমতা বেশিরভাগ পরিবারেরই নাই। আর প্রাকৃতিক জলাশয়ঃ যেমন নদী, বিল ও খালে এখন তেমন মাছ মেলে না। এছাড়াও সরকারি জলাশয়ের বেশিরভাগ অংশে স্থানীয়রা মাছ চাষ করছেন। কেউ হয় লিজ নিয়েছেন, আর কেউ ক্ষমতার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন। ফলে প্রাকৃতিকভাবে মাছ শিকারের সুযোগ এখন বেশ সীমিত। এছাড়াও তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আলাদা বরাদ্দ দিয়ে আলাদা টিম গঠন করতে হবে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো তাঁদের আদি ভাষায় কথা ও গান বলতে পারেন, তাঁদের দিয়ে নতুন প্রজন্মকে নিজ সংস্কৃতিকে চেনাতে হবে। চারঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় উৎসব হল 'চৈত সংক্রান্তির মেলা'। সব ধর্মের লোক এই উৎসবে আসেন। চৈত্রের শেষ দিনের এই মেলায় প্রায় হাজার খানেক লোকের সমাগম ঘটে থাকে। অথচ এই মেলার জন্য তাঁরা কোন সরাকারি বরাদ্দ পান না। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ অনেকেই সাহায্য করে থাকেন। পাহাড় কিংবা সমতল, সবখানেই এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যায়। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যাত্রা শুরু করেছি অথচ সমাজের অন্ত্যজদের এখনো সাথে নিতে পারিনি। আর চারঘাটের অন্ত্যজদের আওয়ার যেন প্রভাতের পূর্বেই রাতের অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়।
লিখা হয়েছে।
ব্লগ লিখেছেনঃ
মোঃ আরিফুল ইসলাম
অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
জনাব সুকুমার
সভাপতি, চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতি
জনাব ষষ্ঠী পাহারিড়া
সাধারণ সম্পাদক, চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতি
তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেছেঃ
মোঃ তপু রায়হান, সুরুজ জামান জনি, আফ্রিদি জুলফিকার অর্ণিব, মোঃ মনিরুল ইসলাম, মোঃ রনি ইসলাম ও অন্যান্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন