সরদহের নামকরণের ইতিহাস
রাজশাহী জেলার একটি ছোট্ট জনপদের নাম হল সরদহ বা সারদা। শিক্ষা-দীক্ষার দিক থেকে এই জনপদ অনেক আগে থেকেই রাজশাহী অঞ্চলে প্রশিদ্ধ। সরদহের নামকরণ নিয়ে মোট তিনটি মতবাদ পাওয়া যায়।
১: এক সময় এই অঞ্চলেরর বেশিরভাগ অংশ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। নবাব মুর্শিদকুলী খানের সময় বর্গীরা বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্থান আক্রমণ করে। তখন নবাবের অনেক অনুগত সেনা ও সাধারণ নাগরিক সারদা অঞ্চলে তাবু গেড়ে আশ্রয় নেয়। ফারসী ভাষায় তাবুকে শের বলে। শের থেকে ‘শেরদহ’। এই শেরদহ থেকে ‘সরদহ’ নামটি আসে। ঐতিহাসিক বিচারে এটিই হল সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য মতবাদ। ।
২: তারপরে সরদহ এলাকায় আবার ডাচ, ইংরেজ সহ বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি এই অঞ্চলে তাদের নীল ও রেশম কুঠি স্থাপন করে। তখন এই স্থানটি ছিল রাজশাহী/লস্করপুর পরগণা অঞ্চলের রেশম কুঠির সদর দপ্তর। তখন সবাই এই স্থানকে ‘সদর দহ’ বলে ডাকতে থাকে। সেই ‘সদর দহ’ এর অপভ্রশই হল ‘সরদহ’ বা ‘সারদা’। এই মতবাদটিও বেশ প্রহনযোগ্য ও বিশুদ্ধ একটি মতবাদ। এই মতবাদের পেছনে আরেকটি প্রমাণ হল: বর্তমান পুলিশ একাডেমীর দক্ষিণ দিকে, থানাপাড়ার চরের দক্ষিণে একটি মৌজা ছিল, যা বর্তমানে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেই মৌজার নাম হল “লস্করপুর” মৌজা। এই লস্করপুর মৌজাটি ঠিক এখনকার সরদহ মৌজার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। মৌজার নাম আর পরগণার নাম এক থেকে বোঝা যায় যে এটাই ছিল পরগণার সদর মৌজা।
৩: আরেকটি মতবাদ হল : পদ্মার পলি দ্বারা গঠিত হওয়ার কারণে নদী সংলগ্ন অনেক স্থানে ঘন জঙ্গল ছিল। এখান বাঘ সহ অন্যান্য প্রাণী বাস করত। ‘শের’ অর্থ বাঘ আর ‘দহ’ অর্থ স্থান। পরে এখানে বসতি স্থাপিত হলে ‘শেরদহ’ থেকে সরদহ নামের উৎপত্তি। তবে এই মতবাদটি সবচেয়ে দূর্বল মতবাদ। কারণ, আগে প্রায় সব জঙ্গলেই বাঘ থাকত। ফলে একটি নির্দিষ্ট স্থানকে `শেরদহ' বলার কোন কারণ থাকতে পারে ন।
ইংরেজরা Sardah থেকে h বাদ দিয়ে শুধু সারদা (Sarda) বলে ডাকতে থাকলে এই অঞ্চলের নাম `সারদা' হয়ে যায়।
সরদহ নামে আজকের দিনে অনেক গ্রাম পরিচিত হলেও মূল সরদহ ছিল এখনকার থানাপাড়ার পদ্মার চর এলাকা। পরে ১৯১২ সালে পুলিশ একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয় সরদহ গ্রামের মাঝ বরাবর। পুলিশ একাডেমীর পশ্চিম আর পূর্ব পাশে ছিল সরদহ মৌজা। আর দক্ষিণে ছিল পদ্মার ধার ঘেঁষে লস্করপুর মৌজা। পুলিশ একাডেমীর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয় মেদীনিপুর স্টেট থেকে। পরেে আরো জমি অধিগ্রহন করলে সেখানকার বাসিন্দারা দক্ষিণে চলে আসে। পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সরদহ গ্রাম সেটা আরাজী সাদিপুর মৌজাতে প্রসারিত হয়। পরে পদ্মার চরে চারঘাট থানা স্থানান্তর করা হলে এই পুরা এলাকা ‘থানাপাড়া’ নামে পরিচিতি পায়।
সরদহ নামে এখন একটা ইউনিয়ন আছে। তবে বর্তমান চারঘাট পৌরসভার ১-৫ নং ওয়ার্ড সাবেক সরদহ ইউনিয়ন থেকে নেওয়া হয়েছে। মৌজাতে ১৮২১ থেকে ১৮২৫ পর্যন্ত সরদহ রাজশাহী জেলার সদর ছিল। ১৮২১ সালে নারদ নদীতে পলি জমে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিলে রাজধানী কলকাতার সাথে রাজশাহীর সদর দপ্তর ‘নাটোরে’র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইংরেজরা নাটোর থেকে রাজশাহী সদর দপ্তর ও বিচারিক কার্যালয় ‘সারদা’তে স্থানান্তর করে আনে। ৪ বছর সারদাতে রাজশাহীর সদর দপ্তর থাকার পর ইংরেজরা ‘বোয়ালিয়া’ বন্দরকে রাজশাহী সদর বলে ঘোষণা করেন। ঠিক কি কারণে সারদাকে বাদ দিয়ে বোয়ালিয়াকে রাজশাহী জেলার সদর দপ্তর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সেটা এখনো রহস্যাবৃত।
সরদহ নামের জনপদের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৩০০-৩৫০ বছর পূর্বে। তার আগে এই জনপদ 'বড়াল' (গঙ্গা) নদীর গর্ভে নিমজ্জিত ছিল। ১৬৬০ সালের পর, পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে সরদহের বেশির ভাগ জনপদ দৃশ্যমান হয়। এ সময় বড়াল নদীর উৎস মুখে পলি পরলে 'থানাপাড়া ও কুটিপাড়া' গ্রামের সৃষ্টি হয়। অবশ্য কুটিপাড়া আগে থানাপাড়া নামেই পরিচিত ছিল। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে নদী ছোট হয়ে যায় আর অসংখ্য বিলের সৃষ্টি হয়। বর্ষাকালে নদীর পলি দ্বারা এসব বিলের অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভূমি গুলি আস্তে আস্তে বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠে। আজকের 'ঝিকড়া' ও 'বালিয়াডাঙ্গা' গ্রাম সহ অসংখ্য গ্রাম এভাবেই তৈরি হয়েছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ। এত দারুণ তথ্যবহুল লেখা দিয়ে উপকার করার জন্য। নিরন্তর শুভ কামনা রইলো।
উত্তরমুছুনচারঘাট উপজেলা নামকরণের ইতিহাস
উত্তরমুছুনআপনাদের ধন্যবাদ, তবে ব্লগটা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি।
উত্তরমুছুন