চারঘাটের বৈশাখী মেলা/কালু পীরের মেলা
প্রতি বছর চারঘাটে বৈশাখ মাসে বড়াল পাড়ে কালু পীরের মেলার আসর বসে। স্থানীয়ভাবে এই মেলা কালু পীরের মেলা হিসেবে পরিচিত। শত শত বছর থেকে চলে আসছে এই আসর। আগে বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার এই মেলার আসর বসত। কয়েক বছর হল প্রতি বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার মেলা বসছে। সব বয়সি মানুষ এই মেলার অপেক্ষায় থাকে। কালু পীরের মেলা নিয়ে স্থানীয়দের কাছে বেশ কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কথিত আছে যে, কালু ও গাজী নামক দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল ছিল। কালু নামের এক সন্ন্যাসী তার আদ্ধাতিকতার জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিলেন আর পীর উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি গঙ্গা পার হয়ে চারঘাটের প্রাচীন চন্দন শহর, তিজ্জমপুর প্রভৃতি গ্রামে আসতেন। তিনি পাথরের ওপর দাড়িয়ে নদী পার হতেন বলে কথিত আছে। কালু পীরের আগমন উপলক্ষে তাঁর ভক্তরা ভীড় জমাত। অনেকে অনেক সদায় নিয়ে আসতেন। আস্তে আস্তে তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে মেলার আসর বসতে শুরু কের। ইতিহাসে সেটাই কালু পীরের মেলা হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে ভিন্ন মতো আছে। অনেকেই মনে করেন যে এটা কালু পীরের মেলা নয়। কালু পীর কোন কালে এই স্থানে অবস্থান করেননি। বস্তুত কালু ছিলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক জমিদার সেকান্দারের পুত্র গাজীর খুব কাছের
একজন বন্ধু। মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে তাঁদের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। রায়মঙ্গল কাব্যে তাদের নামের উল্লেখ আছে। দুইজনে একসাথে দক্ষিণ অঞ্চলে যান আর বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার এক হিন্দু জমিদারকে পরাজিত করেন। পরে কার কন্যা চম্পাবতি কে বিবাহ করেন। তারপর সুন্দরবন এলাকায় ইসলাম পচার করেন। তাঁকে স্থানীয়রা বাঘের দেবতা মানতে থাকেন। ঝিনাইদহ জেলায় কালু,গাজী ও চম্পাবতির মাজার আছে। এদিকে চন্দন শহরে অন্য একটি পীরের শীর্ষরা, সেই পীরের আগমনকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করত। পরে সেই পীর মারা গেলে কালু পীরের কোন এক শীর্ষ তাঁর নামে এই মেলার নাম করণ করে। কালু পীরের খ্যাতির কারণে মেলার নামডাক চারদিকে ছড়িয়ে পরে। তখন দুই বাংলার লোকের সমাগম হতে থাকে মেলায়। মেলা উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে অতিথি সমাগম হতো। সার্কাস ও যাত্রাপালার প্যান্ডেল বসত। ছোট-বড় নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দেখা মিলত মেলায়। নৌকা যোগে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসত। বড় বড় জাহাজে করে পণ্য আসত। হরেক রকম বজরায় আসত জমিদার - জোতদারের পরিবারের সদস্যরা। কথিত আছে এই মেলা তিজ্জমপুর প্রভৃতি পদ্মায় ডুবে গেলে মেলাটি স্থানীয় ইমদাদ নামর এক ব্যাক্তির আম বাগানে বসত। এখানে দীর্ঘদিন মেলার আসর বসার পর মেলাটি চারঘাট উপজেলা
চত্বরে বসতে শুরু করে। পরে উপজেলা সংলগ্ন রাস্তা আর সর্বশেষ বর্তমানে বড়াল পাড়ে চারঘাট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মেলার আসর বসছে। বর্তমানে মেলার জৌলুশ আর নেই। আগের মত পণ্য আর মেলায় আসে না। লোক সমাগমও কমে গেছে। তারপরও বৈশাখ মাস আসলে সবার নজর থাকে মেলার দিকে। বিশেষ করে বাচ্চারা মেলা থেকে ছোট ছোট খেলনা গাড়ি, মাটির পুতুল,মাটির ব্যাংক ইত্যাদি কিনে থাকে। মেলায় দৈনন্দিন কাজের আসবাব পত্র,মাটির তৈরি তৈজসপত্র, বিভিন্ন কসমেটিকস সামগ্রী বিভিন্ন প্রজাতির ফুলও ফলজ বৃক্ষমেলায় শোভা পায়। মেলায় চারঘাটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন বেড়াতে আসে। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও মেলা ঘুরতে আসে। মেলার মূল আকর্ষণ হল মেলার বিশেষ জিলাপী। এত সুস্বাদু জিলাপী মেলা চলে গেলে বাজারে আর পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে কালু পীরের মেলা চারঘাটের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। সরকারি পৃষ্টপোষকতা পেলে আবারো বৈশাখী মেলার পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
ব্লগ লিখেছেনঃ
মোঃ আরিফুল ইসলাম অভি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ
মোঃ আব্দুল কুদ্দুস
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন